আলোচনা বা সমালোচনার পূর্বে টিভি মিডিয়াগুলোতে সাম্প্রতিক দৃশ্যমান
প্রথম আলো পত্রিকার বিজ্ঞাপন চিত্রটি ইউটিউবের বদৌলতে নিচে একটু মনোযোগ
দিয়ে আসুন আরেকবার দেখে -শুনে নেই।
বিজ্ঞাপনের মূল কথা- উট পাখির নয় মানুষের জীবন চাই।
সমাজে চোখের সামনে অনাচার হচ্ছে আর মানুষগুলো বালুর মধ্যে মাথা লুকাচ্ছে। বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে এটা উট পাখির একটা আচরণ। বিজ্ঞাপনে উট পাখির নামে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যজনিত চিৎকার এবং চিত্র বারবার দৃশ্যমান।
ধারনা করা হয় বিখ্যাত রোমান চিন্তাবিদ এবং প্রাকৃতিক দার্শনিক লিনি দ্যা এলডার (খ্রিষ্টপূর্ব ২৩- ৭৯) কর্তৃকই সর্বপ্রথম উটের বালুর মধ্যে মাথা লুকানোর এই ধারনা শুরু হয়েছিল। তিনি সর্বমোট ৩৭ টি খন্ডে তার প্রাকৃতিক ইতিহাস রচনা করেন। এর মধ্যে ১০ম খন্ডের ১ নং অনুচ্ছেদে তিনিলিখেছিলেন -
“…they imagine, when they have thrust their head and neck into a bush, that the whole of their body is concealed” অর্থঃ ...তারা (উট পাখি) মনে করে যখন তারা তাদের মাথা ও গলা কোন ঘন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে তখন তাদের পুরো দেহ ঢেকে যায়।'এই পৌরাণিক ধারনার বাস্তব কোন ভিত্তি নেই বলেই পরবর্তীতে প্রমানিত হয়েছে।
এই বিষয়ে গ্লোবালভয়েসের বিশিষ্ট অনুবাদক এবং ব্লগার বিজয় মজুমদার কয়েকদিন আগে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন---
উটপাখির মান এবং প্রথম আলোর সম্মান।
উটপাখির জীবন চাই না, এই বিজ্ঞাপনে উটপাখির সম্মান নিয়ে টানাটানি করা হয়েছে।
উটপাখি বিপদ দেখলে বালিতে মুখ লুকিয়ে ফেলে, এটা একটা প্রচলিত বিভ্রান্তিকর মীথ মাত্র। ধারণা করা হয়, উটপাখিকে বালির মধ্যে কোন কিছু খুঁটিয়ে খেতে দেখে, কারো কারো মাথায় এই চিন্তাটি এসেছিল, যা পরে এক জনপ্রিয় ধারণায় পরিণত হয়। বাস্তবে আর সব প্রাণীর মত বিপদ টের পেলে হয় সে রুখে দাড়ায় কিংবা পালিয়ে যায়।
একটি প্রাপ্ত বয়স্ক উটপাখি যখন দৌড়াতে শুরু করে, তখন সে তার দৌড়ের গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং প্রায় অর্ধ কিলোমিটার পর্যন্ত সে এই গতি বজায় রাখতে পারে।
উটপাখির মুখে মানুষের ভাষা নেই বলে সে এই বিজ্ঞাপনের প্রতিবাদ করতে পারছে না।
এই নিরীহ প্রাণীর চরিত্র হনন করে, ভাল কিছু বলতে চাওয়ার বিষয়টি ভাল লাগল না।
প্রথম আলো একটা স্মার্ট পত্রিকা, কিন্তু বিজ্ঞাপনটা!
বিজয় মজুমদারেরর স্ট্যাটাস পড়ার পর উট পাখি সম্পর্কে সম্যক ধারনা লাভের চেষ্টা করলাম এবং সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতে পারলাম উট পাখি স্বল্প পরিমাণ মষ্তিস্কের অধিকারী হলেও মাথা বালুতে লুকালেই পুরো দেহ নিরাপদ হয়ে যায় এতটা নির্বোধ ধারনা উট পাখি আদৌ পোষন করেনা। বরং ওটা সম্পূর্ণই একটা পৌরাণিক ধারনা। সেই পৌরাণিক ধারনা থেকেই একটা প্রবাদের মত চালু হয়েছে 'an ostrich with its head in the sand'। ধন্যবাদ বিজয়দা।
http://www.abc.net.au এর বালুতে উট পাখির মাথা নামক আর্টিকেল থেকে এ বিষয়ে জানতে পারি-
The English language is very rich and descriptive. Someone “hiding their head in the sand, like an ostrich” is said to be foolishly ignoring their problem, while hoping it will magically vanish. The ostrich does many things, but hiding its head in the sand is not one of them.
উট পাখি যখন খাবার খোঁজার জন্য নিচু হয় তখন কখনও কখনো তার মাথা আর গলা বালুতে নামিয়ে আনে যাকে দূর থেকে দেখেল মনে হয় বালুতে মাথা লুকিয়েছে। তাছাড়া সিংহ জাতীয় শিকারী প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা কখনও কখনও লম্বা গলা আর মাথা বালুতে বিছিয়ে পাখনা দিয়ে শরীর ঢেকে বালুর উপর ঢিবির মত শুয়ে থাকে।সম্ভবত এই সকল ধারনা থেকেই সেই প্রাচীন চিন্তাবীদ উট পাখির বালুতে মাথা লুকানোর ধারনা বিবৃত করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবিক উট পাখি বালুতে মাথা লুকিয়ে বিপদ থেকে বোকার মত নিজেকে আড়াল করেছে এমনটা ভাবে না।
দু'পায়ের প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন প্রাণী হলো উট পাখি। এর গতি ঘন্টায় প্রায় ৭০ কিমি এবং স্বাভাবিকভাবে অনেকক্ষণ প্রায় ৫০কিমি বেগে একটানা দৌড়াতে পাড়ে। উটপাখি স্বভাবত নিরীহ প্রাণী, তবুও বিপদ দেখলে তারা দৌড়ে পালায়, প্রয়োজন হলে রুখে দাঁড়ায় এবং তখন সম্মুখে পা দিয়ে লাথি মারতে পারে।
আমরা মানুষরা অনেক সময় অন্যিয় অনাচার দেখে ভয়ে নিজেকে লুকাই , এ বিরূপ বাস্তবতার সত্যতা চারপাশে বিরাজমান। কিন্তু উটপাখি তেমনটা করেনা। তার মাথা বালুতে নামিয়ে খাবার খোঁজা বা বসে থাকা বিরূপ নয় বরং এটাই এ প্রাণীর স্বাভাবিক আচরণ। উটপাখি যে কাজটা করেনা বরং যে ধারনা একটা মীথ মাত্র তার সাথে মানুষের মাথা লুকানোর কাল্পনিক যোগসূত্র বানিয়ে উটপাখিকে দোষারোপ করা একটা নিরীহ অবলা প্রাণীর অবলাত্বের সুযোগ নেয়ার মতই ব্যাপার।
আমরা মানুষেরা অনাচার, অত্যাচার দেখে লুকিয়ে ভাবি নিজে নিরাপদ; কিন্তু উট পাখি তেমনটা করে না বলেই উপরের আলোচনায় জানা গেলো। মানুষের জীবন চাই - এ কথাটি খুবই সত্য এবং এটা চাইতেই হবে, কিন্তু উটপাখির নয় এ কথা বলাটা অকারণ , অপ্রয়োজনীয় এবং উটপাখিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার মত বিষয়।
বিজয়দারসাথে গলা মিলিয় বলতেই হয় উটপাখি প্রতিবাদ করতে পারেনা ।
তাই বলে আমরা মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হয়ে এমন একটা অমূলক মীথকে পুঁজি করে বিজ্ঞাপন বানানোর আগে আরও কি গভীরভাবে উটপাখির আচরনের বাস্তবতা জেনে নিতে পারতাম না?
লেখাটিকে যথার্থ মনে করি।
উত্তরমুছুন