এক.
কবে প্রথম এখানে আমি আর আমার স্ত্রী প্রথম
এসেছিলাম ঠিক জানি না; আমরাতো দিন তারিখের হিসেব বুঝি না; আসলে বুঝতাম না।
তবে প্রায় রোজ শুনতে শুনতে সন-বছরের একটা ধারণা এখন আমাদের হয়েছে। কি
সুন্দর করে ওরা বারবার উচ্চারণ করে-
ত্রিশ দিনেতে হয় মাস সেপ্টেম্বর, সেই রূপে এপ্রিল, জুন আর নভেম্বর
আটাশ দিনেতে হয় মাস ফেব্রুয়ারি, প্রতি চারবছরে বারে একদিন তারই
আর বাকী সাত মাস একত্রিশ দিনে, এইরূপে গণনা ইংরেজী সনে।
কয়েকবার
শুনলেই তো যে কারও মুখস্ত হয়ে যাবার কথা। আমরা তো শুনি রোজ। বছরের এই
হিসাব থেকে ধারণা করতে পারি আমরা এখানে এসেছিলাম তা প্রায় এক বছর তো হবে।
সেদিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আমাদের ঘর তখনও
বানানো সম্পূর্ন হয়নি। আধাখেঁচড়া করে বানানো ঘরেই থাকার জন্যে চলে
এসেছিলাম।
আসলে আমরা দু’জন বিয়ে করার পর ঠিক করেছিলাম গোত্রের আর
সবার থেকে দূরে একটু নিরিবিলি কোন সুন্দর পরিবেশে আপন নীড় গড়ে তুলব। স্থান
খুঁজতে খুঁজতে এই জায়গাটা চোখে পড়া মাত্র আমরা দুজনেই একসাথে নেমেছিলাম।
সামনে বড় একটা উঠোন। উঠোনের চারপাশে ঘিরে লম্বা লম্বা গাছ। কয়েকটা গাছের
নাম আমি জানি, বিশেষ করে কৃষ্ণচূড়া গাছ আর কড়ই গাছ। কড়ই গাছ খুবই বিশাল
আকারের হয়। কৃষ্ণচূড়ার ডালে তখন আগুন ঝরছিল। লাল ফুলগুলোর দিকে আমরা নিবিড়
নয়নে তাকিয়ে আগুন ফুলের রূপ গিলছিলাম। বাতাসে লম্বা গাছের বিশাল
পত্রসম্ভার নড়ে উঠছিল আর আমরা আরও আবেগে আপ্লুত হচ্ছিলাম, আপন সুরে আমার
স্ত্রী গান গেতে শুরু করেছিল। কাছেই সাদা হাতার নীল ফ্রক পড়া একটি বালিকা
আমার স্ত্রীর সাথে কণ্ঠ মিলাচ্ছিল, ভয়ে আমার স্ত্রী কেঁপে উঠেছিল। আমি
স্বান্তনা দিয়ে বলেছিলাম, আরে দূর ওটা একটা নিষ্পাপ শিশু মাত্র। হঠাৎ ঘন্টা
বাজার কর্কশ আওয়াজ শুনে একটু সময়ের জন্য আমার ছোট হৃদয়ও কেঁপে উঠল। ঘন্টার
আওয়াজ শেষ হবার একটু পরেই চারপাশে আমরা আরও অনেক বালক বালিকাকে ছুটতে
দেখেছিলাম। কি নিষ্পাপ চেহারা ছেলেমেয়েগুলোর! বালক সকলের পরনে সাদা জামা,
নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর বালিকা সবার নীল ফ্রক, ভেতরে সাদা জামা, নীলের
বাইরে সাদা জামার হাতদুটো কেবল দেখা যাচ্ছিল তাদের। প্রথমে ভয় পেলেও আমার
স্ত্রী এতগুলো মিষ্টি মুখ দেখে আপ্লুত হয়েছিল বেশ।
আমরা অবশ্য
নিজেদের শরণের চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত হলাম দ্রুত। গাছগুলোর পেছনে তিনদিক জুড়ে
লম্বা অনেকগুলো ঘর। একটা সাথে আরেকটা লাগানো। উপরে চকচক করছে টিনের ছাদ।
প্রতিটা ঘরের সামনে লম্বা বারান্দা। বারান্দায় এ মাথা থেকে ও মাথা দড়ি
টানানো দেখে আমরা নামলাম। আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তখন সময়ের হিসাব
জানতাম না। এখন তো জানি। ‘চব্বিশ ঘন্টায় একদিন, এক ঘন্টায় ষাট মিনিট, এক
মিনিটে ষাট সেকেন্ড’...এসব রোজ শুনিতো, শিখে ফেলেছি। এক থেকে দশ পর্যন্ত
অংকও আমরা চিনি। সাথে শিখেছি কিছু নামতাও-‘দুই এককে দুই, দুই দু গুনে
চার...’ কি মিষ্টি লাগে যখনসবগুলো বালাক বালিকা সমস্বরে কিচির মিচির করে
বলতে থাকে।...
এইসব হিসাবে বলতে পারি আধ ঘন্টাখানেক পরেই পুরো এলাকা
শুনশান নীরব হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে সেদিনের মতো ফিরে
যাচ্ছিলাম। সামনেই দেখি সরু গাছের মত একটা লম্বা দন্ড, তার মাথায় একটা সবুজ
কাপড় উড়ছে, কাপড়ের মাঝখানে রক্ত রঙের বৃত্ত। তখন চিনিনি। পরে জেনেছি ওটা
স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। পতাকা মানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের একটা
প্রতীক, এক বিশাল গৌরব। আমরা কিন্তু পতাকার মাপ ও জানি; কালো দেয়ালে ছবি
এঁকে কতবার আমাদের চোখের সামনে শিক্ষক ছাত্র ছাত্রীদের পড়ালেন।
আমরা
কিন্তু সেদিনই জায়গা নির্বাচন করে ফেলেছিলাম। তারপরোও স্বভাব বলে কথা,
ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য পরপর তিনদিন ঠিক বিকেলে আমরা আসতাম। ঘন্টার
আওয়াজে তখনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন না শুনলেই বরং বেদনা এসে মাথায়
ঢোকে। চতুর্থ দিনে আমরা তল্পি তল্পা নিয়ে আমাদের স্বামী স্ত্রীর নিজের নতুন
সংসার শুরু করলাম। ঘরের মাত্র এক চতুর্থাংশ তৈরী করতে পেরেছিলাম। ভাবছেন
এক চতুর্থাংশ কোথায় শিখলাম। এইতো কয়েকদিন আগেই এক শিক্ষক এক বালিকাকে
জিজ্ঞেস করছিলো, বলতো বিশের এক চতুর্থাংশ যদি পাঁচ হয় তবে একশত’র এক
চতুর্থাংশ কত? মেয়েটা উত্তর তো পারেইনি বরং উল্টো প্রশ্ন করেছিলো, স্যার
চতুর্থাংশ মানে কি? আমার তো এসব আরও আগেই শুনে শুনে শেখা হয়ে গেছে, আমি তাই
ঠিকই বলে দিয়েছিলাম, চার ভাগের এক ভাগ। কিন্তু সে তা শুনবে কেনো, আমার
দিকে কি তার খেয়াল থাকে, সারাক্ষণ ক্লাশে বসে কাটাকুটি খেলতে থাকে পাশের
বালিকার সাথে। দিলো শিক্ষক কান মলে, কি ফর্সা মুখটা তার! একদম লাল হয়ে
গেলো। শুধু তাই, বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হলো কান ধরে। আমি স্ত্রীকে বললাম, ঐ
দেখো দুষ্টুমির ফল।
তা যা বলছিলাম...আমরা সেই এক চতুর্থাংশ তৈরী করা
ঘরে স্বামী স্ত্রী জাড়াজড়ি করে সে রাত কাটানোর জন্য তৈরী হচ্ছিলাম, ওমা
বলা কওয়া নেই প্রচন্ড বাতাস বইতে লাগলো, একটু পরেই শুরু হলো ঝমঝম বৃষ্টি।
আমরা ভিজে যাচ্ছিলাম। বাধ্য হয়ে ভেতরে নেমে আমরা একটা বেঞ্চের মধ্যে ঢুকে
পড়েছিলাম।
সে রাতে অনেক ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের অসম্পূর্ন ঘরটির সমস্ত
খড়কূটো উড়ে গিয়েছিলো। তবে আমরা সেদিন এক নতুন বন্ধু পেয়েছিলাম। বেঞ্চটিই
হলো সেই বন্ধু যার মাঝে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। সে ঘুমাচ্ছিল। সারাদিন বালক
বালিকরা তার উপর বসে, লাফায়, সে হাসে, সে আমাদের বলেছিল যখন কেউ তার উপর
কান ধরে দাঁড়ানোর শাস্তি পায় সে কাঁদেও। শুধু বেঞ্চ না এই ঘরের প্রতিটি
বস্তুর সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েগিয়েছিল। কালো দেয়াল, দেয়ালে লেখার সাদা
সাদা খড়ি। লেখা মোছার ডাষ্টার, দেয়ালে টানানো বাংলাদেশের ম্যাপ, টেবিলের
উপর ছড়ানো ছিটানো বইগুলো, যেগুলো কোন না কোনদিন কেউ না কেউ ফেলে যায়, এমনকি
কালো হুলো বেড়ালটাও আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। লেখাপড়ার পাঠ শুনতে শুনতে
তার মধ্যেও একটা নিরীহ ভাব চলে এসেছিল। আমরা খেয়াল করেছি কখনও এমন হয়েছে
পেছনের খালি বেঞ্চের উপর বসে শিক্ষকের পড়া শুনছি আর বেড়ালটা বসার লো বেঞ্চে
বসে চোখ বুজে ঠিকই শুনছে অথচ আমাদের ধরার জন্য একটুও উতলা হচ্ছে না। আসলে
বিদ্যালয় এমন এক স্থান যেখানে সত্যিই জাগতিক সহিংসতা পরিত্যাজ্য, এ জায়গা
কেবল মানুষ গড়ারই কারখানা।
দুই.
অনেকদিন
ধরে আমাদের লেখাপড়া শেখা হচ্ছে না। এমনেতেই শীতের এই সময় বিদ্যালয় বন্ধ
থাকে সে আমার জানি। তারোপর আমরা শুনেছি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা
স্বাভাবিকতার মাত্র ছাড়িয়ে বিপদ শঙ্কুল সীমানা অতিক্রম করছে। রোজ রোজই
অবরোধ, হরতাল এসব চলছে। রোজই কিছু মানুষ সহিংসতায় পটল তুলছে। ক্লাশ অনেকদিন
ধরেই ঠিকমতো হয় না। বালক বালিকারা স্কুলে আসে না। আমাদের ভালো লাগে না।
আমাদের
বাসাটা যে ক্লাশের ভেন্টিলেটারে তারপাশের ক্লাশে কি মনে করে আমরা দু’জন
একদিন গিয়ে বসেছিলাম জানালায়। ওমা! আমাদের নিয়ে কবিতা পড়াচ্ছিল ম্যাডাম
আপা। কি সুন্দর কবিতা। আমাদের নিয়েই তো লেখা-
বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,
‘কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা 'পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।’...
এরপর
আমাদের বদনাম করা হয়েছে, বাকীটুকো তাই আর আমি আউরাই না। কিন্তু আমি আমার
স্ত্রী গর্বিত।কত চড়ুইকে ডেকে এনে কবি রজনীকান্ত সেনের লেখা ‘স্বাধীনতার
সুখ’ নামের এই কবিতা শুনিয়েছি আমরা তার কোন হিসেব নেই। ...ক্লাশ নেই, কবিতা
শোনা বন্ধ। মানুষের মুখে নিজের নাম শুনতে কতই না ভালো লাগে। মাঝে মাঝে উড়ে
গিয়ে ঐ টেবিলের কোনায় পড়ে থাকা বইটি ঠোঁটের খোঁচায় উল্টে কবিতাটা আমি
দেখে নেই। ঠিকমতো পড়তে তো পারি না। মুখস্ত আউরাই, এত চেষ্টা করলাম কিন্ত ঐ
বানান করে পড়াটা শেখা হলো না। আসলে ও মানুষের বাচ্চারই কাজ। আমাদের জন্য
নয়।
হঠাৎ তিনদিন আগে দেখলাম কিছু লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। একটা
গাড়ীতে করে অনেক কাগজ পত্র আর বড় স্বচ্ছ বাক্স এনে রাখা হলো বিদ্যালয়ের
একটি ঘরে। প্রথমে কি হবে বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম বালক বালিকারা পরীক্ষা
টরীক্ষা দেবে মনে হয়। পড়াশুনাই হলো না, কি পরীক্ষা দেবে ওরা! কিন্তু
কাছাকাছি গিয়ে শুনলাম পরীক্ষা না, দেশে নির্বাচন। দশম জাতীয় নির্বাচন। এই
বিদ্যালয়টিও একটি ভোট কেন্দ্র। ভোটের ব্যালট পেপার আর ভোট বাক্স আনা হয়েছে।
এর আগে কখনও ভোট কেমনে হয় আমরা দেখেনি। ক্লাশে একদিন এক শিক্ষক ভোট কি
জিনিস ছাত্রছাত্রীদের বলছিলেন। আমরা শুনেছিলাম, গণতন্ত্রে ভোটই জনগণের মূল
হাতিয়ার। এই হাতিয়ার কোন ধ্বংসের হাতিয়ার নয়, এ হলো সরকার তৈরীর হাতিয়ার।
ভোট দিয়ে জনগণ তার পছন্দমতো সরকার তৈরী করবে। এক ছেলে বোকার মত প্রশ্ন
করেছিলো, আচ্ছা যারা ভোটে দাঁড়াবে তাদের কাউকেই যদি জনগণের পছন্দ না হয়
তাহলে পছন্দমত সরকার কিভাবে তৈরী হবে? শিক্ষক বলেছিলেন, না ভোট বলে কিছু
একটা তার জন্য রাখা হচ্ছে আজকাল অনেক গণতান্ত্রিক দেশে।...
আমি খোঁজ নিয়েছিলাম, আসলে কাছে গিয়ে ব্যালেট পেপার উঁকি মেরে দেখেছিলাম, না ভোট বলে কিছু আসলে নেই।
ওহ!
আমার স্ত্রী কিন্তু তিনটি ডিম দিয়েছে গত পরশুদিন। ডিমের তা দিয়ে আমরা
স্বামী স্ত্রী এই নতুন জিনিস দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম।
ভোটের আর মাত্র একদিন বাকী। সেদিনই ডিম ফুটে আমাদের দুটো ফুটফুটে ছানার
জন্ম হলো। একটা তখনও ফোটেনি। আমি তো খুশিতে পুরো বিদ্যালয়ের সবগুলো গাছের
উপর দিয়ে এক চক্কর উড়ে এলাম। বউ বললো, পাগল হলে নাকি। আমি বললাম, তা বলতে
পারো। আমি যে কি করব ভাবতে পারছিলাম না। একবার বেঞ্চের কাছে গিয়ে বলছিলাম
তো আরেকবার কালো দেয়ালের কাছে। আবার একটুও ভয় না পেয়ে কালো বিড়ালটিকেও
শুনিয়ে এলাম। সেও আনন্দে যেন মিঁউ মিঁউ করে উঠল। বারান্দায় যে ঘন্টা টা
ঝুলানো ছিল তাকেও শুনালাম।
তারপর...সন্ধ্যার একটু পর বাচ্চা দুটোর
দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম। কি মিষ্টি চেহারা। তুলতুলে দেহ, গুড়িগুড়ি পশম।
কযেকদিন পর পশম বড় হবে। ডানা গাজাবে। আমার সাথে তাল মিলিয়ে উড়বে...বউ তখন
অন্য ডিমটিতে তা দিতে ব্যস্ত। ...হঠাৎ সেই সন্ধ্যার নীরবতা ভেঙে বেশ কিছু
আওয়াজ কানে এলো। ভাবলাম কাল ভোট, তারই আয়োজন হচ্ছে। কিন্তু ভুল ভাঙলো একটু
পড়েই, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। চারদিক ধোঁয়ার আচ্ছন্ন হয়ে গেলে। আমর ঘর ছেড়ে
বের হয়ে উপরে উড়ে দেখতে চাইলাম কি হচ্ছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে বিদ্যালয়ের
ঘরগুলো। ভাঙা ভেন্টিলেটরে আমাদের ঘর তার উপরের কয়েকটা টিন ঠাস ঠাস করে
নিচে পড়ে গেলো। বুঝতে পারছিলাম মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে।
বাচ্চাদুটোর কি হচ্ছে সে খবর নিতে নিচে নামা আর সম্ভব নয়। আগুনের লাল শিখা
সবকিছু গ্রাস করে নিয়েছে ততক্ষণে। আমরা আগুণের আঁচ থেকে বাঁচতে আরেকটু উপরে
উঠে কৃষ্ণচূড়ার ডালে গিয়ে বসলাম। দেখলাম মশাল হাতে ঐ তো দূরে চার পাঁচজন
লোক ছুটে পালাচ্ছে। আমার স্ত্রী তখন দুচোখ জলে ভিজিয়েই চলেছে। সদ্যজাত দুটো
বাচ্চা! উফ্। আমি বুকে কষ্ট চেপে একটু খানি ভাবলাম, ঐ যে মানুষগুলা আগুন
দিলো ওরাকি কোন বিদ্যালয়ে পড়েনি? ওরা কি আসলে মানুষ না!
পরিশিষ্ট.
সন্তান
হারা চড়ুইদুটো কৃষ্ণচূড়া ডালে বসে বসে আগুনে পুরো বিদ্যালয় পুড়ে যেতে
দেখেছে। যে গাছটিতে তার বসেছিল সেটিরও অনেকাংশ পুড়ে গেছে। আগুন লাগার
ঘন্টাখানেক বাদে আশেপাশের লোকালয়ের মানুষজন ছুটে এসেছিল। বালতি বালতি পানি
ঢালছিল। নিষ্ঠুর আগুন পতাকার দড়ি ঝুলে পতাকা পর্যন্তও পৌঁছে গিয়েছিল,
অর্ধেক পুড়ে শিখা সেখানে প্রায় নিভু নিভু তখন। পুরুষ চড়ুইটি তাকিয়ে দেখছিল
আর ভাবছিলো, ‘স্বাধীনতার প্রতীকও অর্ধেক পুড়ে গেলো!’
ফায়ার ব্রীগেড
এসেছিলো আরও ঘন্টাখানেক পরে। লাভ হয়নি, একটাও বেঞ্চ আর চেয়ার টেবিল কয়লা
হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। স্ত্রী চড়ুইটি আগুনের শিখা নেমে যাবার পর
পরই উড়ে নেমে যাচ্ছিল বাচ্চাদের খুঁজতে। পুরুষ চড়ুইটি তাকে আটকে রেখেছিল।
সে জানে ওখানে এখনও ভীষণ উত্তাপ। দুর থেকে অবশ্য তারা দেখেছিল তাদের ঘরটি
যেখানে ছিল সেখানে এক দলা কালোছাই। স্ত্রী চড়ুই বলল, ওটার মধ্যেই আমাদের
কলিজার ধন, লক্ষ্মী মানিক দুটো... হু হু করে কেঁদে ফেললো। একটু পরেই তারা
দেখতে পেলো উঠোনে এক বুড়ো এসে হু হু করে কাঁদছে। তারা তাকে চিনলো।
বিদ্যালয়ের হেড মাষ্টার। তারা জানে তার কাছে বিদ্যালয়টি সন্তানের চেয়ে কোন
অংশে কম না।
কৃষ্ণচূড়ার ডাল ছেড়ে ভোরের আলো ফোঁটার কালে
তারা নেমে এল। উড়ে এলো পুরো ধ্বংস স্তুপের উপর দিয়ে কয়েকবার। কিছুই চেনা
যাচ্ছে না। দরজা টেবিল, চেয়ার, বেঞ্চ সব পুড়ে ছাই। লাইব্রেরিটার দিকে দেখলো
কালো ছাইয়ের মাঝে কদাচিৎ কিছু সাদা অংশে কালো হরফ অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ চোখে পড়ল বারান্দার এক কোনে ঘন্টাটা একা পড়ে আছে চুপচাপ। কোন শব্দ
করছে না। তবে সেই বোধহয় একমাত্র বস্তু যে মোটেও পোড়েনি, কেবল পুড়েছে
ঝুলানোর দড়িটা। পাশেই কালো বিড়ালটা পুড়ে কাবাব হয়ে পড়ে আছে। সে দৃশ্য তাদের
কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিলো।
সকাল হবার পর পুরুষ চড়ুইটি একটা কোণে একটা পোড়া
বইয়ের উপর বসেছিলো। সেখানে সে দেখতে পেলো সেই কবিতাখানা। পুরো নয়, পড়তে না
পারলেও চিনলো শেষের অংশুটুকু...
...
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজেরও বাসায়।
পাকা হোক, তবুও ভাই পরেরও বাসা
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।
...এই
প্রথম সে শেষ দুটো লাইন আউড়ালো। তারপর দেখলো পালে পালে বালক বালিকারা
বিদ্যালয়ের দিকে ছুটে আসছে। সে খুব অবাক হলো, যে বালাক বালিকাগুলো পড়াশুনা
করতো না, রোজ বিদ্যালযে পালানোর ফন্দি আটত, তারাও হু হু করে কাঁদছে। তারপর
আকাশে তাকিয়ে দেখলো স্ত্রী চড়ুই টি উড়ে আসছে, তার মুখে ধরে আছে একটা চড়ুই
শিশুর মৃতদেহের কাবাব।
@মামুন ম. আজিজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন