হঠাৎ টেলিভিশনে রাজনীতি বিষয়ক উত্তপ্ত
কথার উষ্ণ প্রস্রবণ বিহীন একটি টক শো চোখে পড়তেই দেখার সাধ হলো। সাধ না হয়ে
উপায় নেই, সাহিত্যের সাথে কিঞ্চিৎ যোগসূত্র থাকায় এমন একটি অনুষ্ঠান আমাকে
টানবে সেটাই খুবই সংগত। সংগত কর্মটিই হলো। আমি দেখতে বসলাম সময় টিভির গত
শনিবার রাতের সম্পাদকীয় অনুষ্ঠানটি। অনুষ্ঠানটির আলোচনার বিষয় ‘বাঙালির
প্রাণের মালা’। গত সন্ধ্যায় সেই প্রাণের মেলা, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৪
উদ্বোধন হয়েছে বাংলা একাডেমী চত্বর এবং সংযুক্ত সোহয়ারাওয়ার্দী উদ্যানের
কিছু অংশ জুড়ে । অনুষ্ঠানের আলোচনায় অতিথি আমাদের সাহিত্য জগতে খুবই
পরিচিত, সমসাময়িক তিন দিকপাল। ১।শামসুজ্জামান খান (মহাপরিচালক, বাংলা
একাডেমি), ২।ইমদাদুল হক মিলন, (লেখক ও কথাসাহিত্যিক), ৩।ওসমান গনি
(সভাপতি, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি)
নতুন
প্রান্তর সংযুক্ত হয়েছে এবার, উঠোনের বিস্তৃতি হয়েছে , বইয়ের আড়ংও বিস্তৃত
হবে, সে সব কথা উঠে আসবে আলোচনায় , সে সব শুনব। গুঞ্জন ছিল, দাবী ছিল,
নেতিবাচক কথা বলার লোকও ছিল এই প্রান্তর ছড়ানোর বিষয়ে। সে সব কথা উঠে আসলও
বটে আলোচনায়।
একটু বলতেই হয়, ঐ যে শুরুতে বলেছিলাম ...রাজনীতি বিষয়ক উত্তপ্ত কথার উষ্ণ প্রস্রবণ বিহীন...আসলে কোন কিছুই এ দেশে রাজনীতি মুক্ত হতে পারে না, যে কারণে রাজনীতি অনিচ্ছাতেই আলোচনায় স্থান পায়, খুবই সামান্য যদিও, যেমন...গত বছর গ্রন্থমেলায় লোক সমাগম বা বিক্রি বাটা ভালো ছিল না, যার মুখ্য কারণ ঐ সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, শাহাবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, আবার এ বছর দীর্ঘদিন অবরোধ, হরতাল, নির্বাচন ...এসব অস্থির অবস্থার কারণে প্রকাশক গণের মেলা নিয়ে সংকায় এবার কম বই প্রকাশ হতে পারে...এসব কথা গুণী অতিথিরা পয়েন্ট আউট করলেন। বারবার তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা সম্প্রসারণকে বর্তমান সরকারের এক ঐতিহাসিক মাইল ফলক বলে অবহিত করলেন। যাহোক এইসবল রাজনীতির ছোঁয়া যুক্ত কথায় দূষণ বোধহয় নেই।
পুরো অনুষ্ঠানটি জুড়ে একুশে গ্রন্থমেলার আদি অন্ত, শুরু, বিস্তৃতি, উত্থান এসব ইতিহাসের আলোচনা দর্শককে বেশ সমৃদ্ধ করলো অবশ্যই।
মুক্তধারার প্রকাশনীর প্রাণ পুরুষ চিত্তরঞ্জন সাহার সেই কয়েকটি বই নিয়ে পাটি বিছিয়ে মেলার সূচনা করেছিলেন সে কথা আলোচনায় ইমদাদুল হক মিলনের কথায় উঠে আসল। একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা বিষয় আসলে চিত্তরঞ্জন সাহার মত পুস্তক প্রকাশে নিবেদিত প্রাণ একজন ব্যত্তিত্বের কথা কি না এসে পারে।
শামসুজ্জামান খান জানালেন ১৯৬৫ সালে সাহিত্যিক সরদার জয়নুদ্দীন ( তৎকালীন বাংলা একাডেমীর কর্মকর্তা) প্রথম বইমেলা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী প্রাঙ্গনে ‘শিশু বইমেলা’ নামে একটি বইমেলা করেন। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনিই বাংলাদেশের বইমেলার জনক বলেও শামসুজ্জামান খান জানালেন। এর পরে সরদার জয়নুদ্দীন নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের উদ্যেগে একটি বইমেলা করেছিলেন। সেখানে মেলায় একটি গরু বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং গরুর গায়ে লেখা ছিল ‘আমি বই পড়ি না’। সরাদার জয়নুদ্দীন কিংবা মুনীর চৌধুরী এই কৌতূক উদ্দীপক কাজটি করে ছিলেন বলেও শামসুজ্জামান খান জানালেন। তিনি আরও জানালেন ১৯৭২ সালে সরদার জয়নুদ্দীন ই (তৎকালীণ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক ) আবার প্রথম বইমেলার আয়োজন করেছিলেন , সে বছর ইউনেস্কো ঐ সালকে আন্তর্জাতিক গ্রন্থ বছর ঘোষনা করেছিল বলেই ঐ উপলক্ষ্যে মেলাটি করা হয়েছিল। সে বছরই মানে ১৯৭২ সালে চিত্তরঞ্জন বাবু আর দু’জন মিলে বাইরে বসেছিলেন পাটি বিছিয়ে।
১৭৭৪ সালে বিশাল সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেখানে ঐ তিনজন প্রকাশকের সাথে আরও ৪/৫ প্রকাশক বই নিয়ে বসলেন। সে বছরেই বাংলা একাডেমীর বইগুলোও যুক্ত করা হলো মেলায় প্রদর্শনের জন্য। এরপর চিত্তরঞ্জন সাহা টুকটাক বইমেলা করে আসছিলেন।
১৯৮৩ সালে প্রথম বাংলা একাডেমীর উদ্যেগে মেলা হবার কথা থাকলেও স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক ছাত্র হত্যার কারণে সে বছর আর মেলা হয়নি, পরের বছর ১৯৮৪ সালেই প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে প্রথাগত ভাবে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, সে মেলায় ৩৬টি প্রকাশক অংশ নিয়েছিলেন।
বাংলা একডেমী পুরষ্কার ইতোপূর্বে মেলার শেষের দিকে দেওয়া হতো, এ বছর থেকে বাংলা একাডেসী সেই পুরষ্কার মেলার উদ্বোধনীর দিন দেয়ার উদ্যেগ নিয়েছে এবং প্রদাণও করেছে, এটাকে অতিথিরা খুবই ভালো উদ্যেগ বলে উল্লেখ করলেন, যুক্তি দেখালেন- পুরষ্কার প্রথমে দেয়া হলে পুরষ্কার প্রাপ্ত লেখকগণের বই বিক্রি বাড়বে, মানুষ জানতে পারবে পুরষ্কার যিনি পেলেন তার লেখার মান সম্পর্কে।
শামসুজ্জামান খান গত বছর বইমেলায় আগুন লাগাজনিত দূর্ঘটনার ব্যাখাটি দিলেন। একজন প্রকাশকের মশার কয়েল জ্বালিয়ে রেখে যাবার কারণেই ওমন একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল তিনি জানালেন। জানালেন এবার ফায়ারবিগ্রেডের ব্যবস্থা থাকবে খোলা পরিসরে।
ইমদাদুল হক মিলন তার প্রকাশিতব্য ৭টি গ্রন্থের সম্পর্কে জানালেন। জানালেন তাদের মত জনপ্রিয় লেখকদেরও বই প্রকাশ বিগত কয়েক বছর ধরে কেবল মেলা কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এটা হওয়া উচিৎ ছিল না।
শামসুজ্জামান খান জানালেন বিদেশি প্রকাশকদের মেলায় নিয়ে আসার একটা পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। এই বিষয়ে অতিথিদের দ্বিমত দেখা গেলো। ওসমান গণি জানালেন আমাদের সাহিত্য জগত এত উন্নত হয়নি যে বিদেশি বইয়ের সাথে প্রতিযোগীতা করতে পারবে। কথা কিন্ত মিথ্যে নয়, কিন্তু একজন সাহিত্য চর্চাকারী হিসেবে আমার প্রশ্ন- ‘উন্নত কেনো হয়নি?’
বাংলা একাডেমীর মহপরিচালক এক ফাঁকে বললেন, ‘...আমরা বইমেলাটা করছি বটে, মানটা কি হচ্ছে, মানটা হচ্ছে-মিলনের বই বের হয়েছে উন্নত মানের বই, সৈয়দ শামুসল হকের বই বেরিয়েছে, উন্নত মানের বই, আমাদের এ রকমক ৫০ জন লেখক তাদের বইয়ের মান উন্নত মানের আর বেশির ভাগের বই তো অনেক ক্ষেত্রে আমি এভাবে বললে অনেকই হয়তো ভাববেন কটূ কথা বললো, কাগজ কলম নষ্ট, সময় নষ্ট, অর্থের অপব্যয় মাত্র, আমরা দেখাচ্ছি ৪০০০ বই বের হচ্ছে, কিন্তু আপনি হিসেব করে দেখেন ২০০ বই বেছে বের করা কঠিন, ..এভাবে কিন্তু ভালো বইমেরা করা সম্ভবপর হবে না। বাংলা একাডেমী সবটাকরে দিতে পারবে না, মুখে তুলে খাইয়ে দিতে পারবে না, এখন প্রকাশকদের এগিয়ে আসতে হবে...’
আলোচনা শেষ পর্যায়ে বিশিষ্ট লেখক ইমদাদুল হক মিলন বললেন আরও ভয়ানক কথা, ‘...৪০০০ বই বের হলে ২০০টি উচ্চমানের বইমানের বই খুঁজে পাওয়া যাবে না, আমি তো মনে করি ৫০টিও পাওয়া যাবে না, ২০০ তো দূরের কথা।’
তিনি আরও জানালেন নিজে নিজে দ্রুত বই বের করে ফেলছে যাদের তার লেখকই মনে হয়না। সাথে মহাপরিচালকও ফোঁড়ন কাটলেন পয়সা হয়েছে বলে নিজেরাই বই বের করে ফেলছেন। মিলন স্যার আরও জানালেন চদকদার বিজ্ঞাপন দেখে সেই সব বই বিক্রিও হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি এও বললেন, ‘বইয়ের ভারে অনেক ভালো বইও হারিয়ে যাচ্ছে...এক শ্রেণীর ভালো লেখক চাপা পড়ে যাচ্ছেন, কিন্তু এদের মধ্যে থেকে কিছু খুব শক্তিমান তরুণ লেখক কে আমরা দেখতে পাই , যে তারও কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন, বা একটা কোন সাহিত্য পত্রিকায় লিখছেন বা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতাটিতে লিখছেন, লিখে লিখে তারা হয়তো গত আট দশ বছরে একটি জায়গা করে নিয়েছেন, এরকম লেখকও আছেন...’
তিনি আহ্বান জানালেণ প্রকাশকদের উচিৎ প্রকৃত লেখকদের খুঁজে বের করতে হবে।
খুবই সুন্দর অভিব্যক্তি দুই গুণীজনের। কিন্তু কিছু কথা থেকে যায়, দু’জনের একজন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক এবং অন্যজন আমাদের বর্তমান দিনে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক এবং একটি অন্যতম পত্রিকার বর্তমান সম্পাদকও তিনি। ওনারা ৪০০০ যে প্রকাশিত বইয়ের কথা বললেন, সত্যি কি সবগুলো বই তারা পড়েছেন, নেড়েছেন.. তা না করাই স্বাভাবিক, করাটা দুসাধ্য। অথচ ৪০০০ থেকে মাত্র ২০০ (কিংবা অন্যজন মাত্র ৫০টি) বইকে মানের বলে দিলেন আর সব তাহলে নিম্ন মানের। যাদের উচিৎ ছিল নতুন লেখক সৃষ্টিতে উৎসাহ, উদ্দীপনা প্রদান এবং প্রয়োজনীয় উদ্যেগ নেয়ার তাঁরাই কত সহজে বলে দিচ্ছেন গণহারে নিম্ন মানের লেখা। অথচ কত সহজেই তারা লেখক সৃষ্টির উদ্যেগ নিতে পারতেন, তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো প্রতি বছর মেলাতেই একজন অন্তত তরুণ, প্রতিভাবান লেখককে পৃষ্টপোষকতা করার। করেন কি? অবশ্য শেষের দিকে শামসুজ্জামান খান স্বীকার করলেন, বাংলা একাডেমীতেই যোগ্য সম্পাদক নেই, প্রুফ রিডার নেই, সেখানেই আউট সর্সিং করতে হয়। বাংলা একাডেমীরই রয়েছে বিশাল দূর্বলতা। বাংলা একাডেমী একদা দুইজন নতুন তরূণের কবিতার বই বের করেছিল। সেটা নিয়ে সমালোচনা হওয়ায় পরবর্র্তীতে আর করা সম্ভব হয়নি। বাংলা একাডেমী নতুনদের , তরুণদের বই প্রকাশে তাদের উদ্যেগ নিতে ভয় পায় সমালাচনার, সেটা তাঁর কথায় উঠে আসলো।
তাহলে সমালোচনার ভয়ে গুণীব্যক্তিরা কি কেবল নিজ সৃষ্টি নিয়েই ব্যস্ত, নতুনদের পথ প্রদর্শক হতে আপত্তি কি? হতে পারে নাও পারে। ইমদাদুল হক মিলন স্যার লিটল ম্যাগে বেশ কিছু তরুণ লিখে লিখে উঠে আসছে বললেন যদিও তথাপি ওনার নিশ্চয় অজ্ঞাত নয় যে প্রায় বেশির ভাগ লিটল ম্যাগ প্রকাশের পেছনের কাহিনী অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ করুণ। সেখানেও পৃষ্টপোষকতা আদৌ গুণীজনেরা খুব বেশি কেউ দেয় কিনা জানি না? আর পত্র পত্রিকার সাহিত্য পাতার কথাতো বলার অপেক্ষাই রাখে না, সে সকলেই বিশেষ করে সাহিত্য জগতে যারা বিরাজ করে তারা মাত্রই জানার কথা, না জানলেও যে কোন পত্রিকার সাহিত্য পাতা খুলে দেখুন, পরিসর আর চিত্র দেখলেই বোঝা যাবে। তার চেয়ে বরং অনলাইনেই সাহিত্য চর্চা এবং পাঠ আজকাল বেশি হচ্ছে। গুণীজনেরা অনলাইনের কথা বার্তার দিকে মোটেও জাননি, তাতে ভালোই হয়েছে, হয়তো অনলাইন সাহিত্য জগতের প্রতি তাদের আরও নেতিবাচক ধারণা অনলাইন সাহিত্য চর্চাকারীদের বেদনার কারণ হয়ে উঠতো। ভালোই হলো।
আমি
ব্যক্তিগতভাবে মিলন স্যারকে তার পত্রিকা অফিসের ঠিকানায় আমার গল্পগ্রন্থ
এবং সংকাশ লিটল ম্যাগ পাঠিয়েছি কয়েকবার। ইমদাদুল হক স্যার আমার বই পেয়েছেন
কিনা বা আদৌ পেলে পড়েছেন কিনা আমার জানা নেই। যদি পড়ে থাকেন এবং যদি কেবল
আমার গ্রন্থ পড়েই উনি সবার সম্পর্কে ধারণা করে নেন, সেটাও ঠিক হবে না।
আসলেই প্রতি বছরই মেলায় অনেক নতুন লেখক বেশ ভালো বই বের করেন আমি বিশ্বাস
করি। সংখ্যাটা যেমন ২০০ বা ৫০ না মোটেও তেমনি ২০০০ও অবশ্যই না।
মিলন স্যার শেষে একটি খুব ভালো কথা বলেলেন। বললেন নতুন লেখকদের অধিকাংশেরই পড়াশুনা খুবই কম।
ভালো বই লিখেতে হলে আসলে প্রচুর পড়াশনা দরকার , ইমদাদুল হক মিলনের এই সুন্দর কথাটি আসলেই কিন্তু লেখক হবার জন্য বিকল্পহীন একটি কথা।
ভালো বই লিখেতে হলে আসলে প্রচুর পড়াশনা দরকার , ইমদাদুল হক মিলনের এই সুন্দর কথাটি আসলেই কিন্তু লেখক হবার জন্য বিকল্পহীন একটি কথা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন