পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

যেদিন বাবা চলে গেলেন

তখন আমার সরকারী চাকুরীর প্রথম পোষ্টিং। অবস্থান হলো কক্সবাজার; সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং ষ্টেশন (বর্তমানে বিএসসিসিএল)। সময়টা ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। প্রায়  এক বছর ধরে কক্সবাজারে আছি। এক নিঃসঙ্গ জীবন অথচ স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া; অনেকটা অনুভূতির তাড়নায়। একাকী অবসরের কিছুটা কাটত চৌদ্দ ইঞ্চি টিভি দেখে, সন্ধ্যায় জিম কসরত করে  আর বাকীটা  সামহয়্যারইন.নেট এ ব্লগীং করে। যদিও ইন্টারনেটের জন্য  ল্যান্ড ফোনের ডায়ালাপের ধীর গতির উপরেই ছিল কেবল নির্ভরশীলতা। তবুও রোজ ধৈর্য্য ধরে পোষ্ট আপলোড করে ব্লগীং করেই চলেছিলাম। এখনও সামহয়্যারে আমার সেই সব পোষ্টগুলোর অধিকাংশই রয়েছে (আইডিটির নাম পথিক!!!!!!!)। রোজকার দিনপঞ্জি নিয়ে কোন ব্লগীং করলে তার ট্যাগে লিখে দিতাম ‘নির্বাসনের দিনকাল’। সেই নির্বাসনের দিনকালে ঝিলংজার নিদারুণ নির্জনতার উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে রওয়ানা হয়েছিলাম এক রাতে আর অন্য সকল যাত্রার মতই। বাস ঢাকা ছেড়েছিল ১০ই ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে। ঢাকা পেরিয়ে কুমিল্লা যাবার আগেই হয়তো দিন পেরিয়ে ১১ই ফেব্রুয়ারিতে পড়েছিল। দীর্ঘ জার্নি। ঘুম আমার ভালোই হতো। মাঝে মাঝে ভাঙতোও। বাসা থেকে গভীর রাতেই এক ঘুম ভাঙানি  মোবাইল কলে জানালো আমাকে-আব্বু খুব অসুস্থ। ঠিক কি বলেছিলাম সে সব শব্দ আজ স্মৃতিতে নেই। তবে হাসপাতালে সকালে নেয়া হবে এতটুকু মনে আছে। সকালে ডরমেটরিতে ফ্রেস হয়ে অফিসেও চলে গেলাম। অফিসটা শ খানেক গজ দূরে পুকুরের অপারেই। মন উতলা হচ্ছিল, আব্বুকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে সে খোঁজ পেলাম। ল্যাপটপ খুলে বসে বসে উচাটন মনে সামহয়্যারইন.নেট এ ঢুকে দু ছত্র লিখে ফেললাম উৎকণ্ঠার প্যাচাল-


আজকে সকালে /// আব্বুর জন্যে ভীষণ মন খারাপ
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ |

জানালার কাচ দিয়ে প্রভাতের রাগী সূর্যের আলো এসে পড়ছিল চোখে ঘুম ভাঙছিল , ভাঙছিল কিন্তু চোখ মেলতে চাইছিল না মন পুরোপুরি এসি বাসের ফাঁটা জানালার কাঁচ দিয়ে দেখে নিলাম রাস্তার দুপাশের ছোট টিলার সারিগুলো কক্সবাজারের কাছাকাছি রামুর কোথাও আছি বুঝতে পারলাম চোখ বন্ধ করলাম ঘুমের সাথে নিঃস্বার্থ আতাতে পাশে সুমন একই রকম অবস্থায় আধো জাগা আধো ঘুম সেজ মামা ফোনটা তখনই এল
কাল কেই তো আব্বুকে সুস্থ দেখে এলাম ( যদিও ভেতরে ভেতরে কঠিন রোগ চাপা সর্বদাই)...মিস্ত্রীরা কাজ করছে , বসে বসে তদারিক করছেন আব্বু সারারাত রক্ত ভোমিটিং হয়েছে সকালে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে সোহরাওয়ার্দিতে ...রক্ত দিতে হবে ডাঃ আমজাদ মামা বলে দিয়েছেন ফোনে ...
মন ছুটে যেতে চায় ...হায়রে চাকুরী!...
আব্বুর রক্তের গ্রুপটা নাকি আবার বেশ রেয়ার এবি পজেটিভ ...কই পাই , কাকে বলি? সুমন কে বললাম ওর ডাক্তার বন্ধূ মহলে একটু জানাতে...জানাল
ইতোমধ্যে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম ....আপুর দেবরের রক্তের গ্রুপ মিলেছে জানাগেলো এক বন্ধুকে ফোন করে একজন ডোনার পেলাম ...মন ভীষন অস্থির সুমন চলে গেলো ওর জিপির অফিসে অস্থিরতা কাটাতে ঢুকলাম ব্লগে তাও অস্থিরতা কাটেনা চিন্তা করছি অফিসে না বলেই বিমানে করে চলে যাব নাকি? ...( যদিও সম্ভব না, গেলে বলেই যেতে হবে)
........শেষ খবর পেলাম, রক্ত এক ব্যাগ পুষ করা হয়েছে আমাকে জানানো হয়েছে ডেঞ্জার ইস অভার কামড . ....কিন্তু মন মানেনা আজকেই কেনো আমাকে আসতে হলো, ..........
হয়তো রক্ত আরও লাগতে পারে আব্বুর রক্তের উপাদানগুলো ভীষন কমে গেছে , অন্যান্য রোগের( লিভার , স্টোন , ডাযাবেটিস...) জটিলতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আরও এক ডাক্তার বান্ধবীকে বলে রেখেছি , বলেছে তারও রক্তের সেম গ্রপ যাক একটু শান্তি ...
যারা দোআয় বিশ্বাসী তারা আব্বুর জন্যে দোআ করবেন আর যারা দোআয় বিশ্বাসী নয় তারা আব্বুর সুস্থতা কামনা করবেন আশা রাখিÕব্লগীংটির লীংক
 ১০ তারিখ শনিবার। দুপুরে এক সাথে ভাত খেয়েছিলাম মাদুরে বসে। আব্বুর সাথে নিচে বসে ভাত খাওয়ার অনিয়মিত একটা চল ছিল। কি কি কথা হয়েছিল সব মনে নেই। দেশের তৎকালিন রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল, তবে দুটো কথা খুব স্পষ্ট মনে আছে। আফসোস করে বলেছিলেন, ‘বাবা দুটো কাজ সম্পন্ন করা হলো না এখনও, তোমার বিয়েটা দিতে পারলাম না, তিনতলার কাজটাও শেষ করা হলো না...’
আব্বু আমাকে তুই করেই বলতেন। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন তুমি সম্বোধন করেই বলেছিলেন। কোন বিশেষ জোর বা আহ্লাদের সুর আনতে উনি তুমি ব্যবহার করতেন আমার উপর। উনি হয়তো টের পেয়েছিলেন, হয়তো সব মানুষই মৃত্যুর আগে টের পায়।
আজ ১২ই ফেব্রুয়ারি। বাবার ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী। যতুটুকু লিখলাম এটুকু লিখতে আমার সাতটি বছর কেটে গেছে। আমি কতবার চেষ্টা করেছি বাবাকে নিয়ে লিখব, কি লিখব, কতটুকু লেখা উচিৎ, সে সবের চেয়ে বেশি আটকেছে এক আড়ষ্টতা, এক মায়া। হঠাৎ আজ যেন কিছু লিখতে খুব মনে চাইলো। একটু আগে এক বিখ্যাত লেখকের নিজ বাবাকে নিয়ে লেখা একটি কাহিনী পড়ছিলাম। হতে পারে সে লেখা এই বিশেষ দিনে এই গভীর রাতে এই লেখার হয়তো অনুপ্রেরণা, হয়তো আমার আড়ষ্টতা কাটল সবে সাতটি বছর পরে। আজ বাবার কথা খুব মনে পড়ে।  বাবা টুকটাক ছড়া, প্রবন্ধ লিখতেন। একটা মোটা খাতা কিনেছিলাম, বাবাকে নিয়ে লিখব, বাবার কথা লিখব, তাঁর লেখাগুলো একসাথে করব। শুরুটা নানান ভাবে ভেবেছি, তারপর কোনদিনই লেখা হয়নি। খাতাটা পুরো াঁকা আজও।
এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেই ১১ ফেব্রুয়ারি। বারবার খোঁজ নিচ্ছি। হাসপাতালে পরিচিত জনরা ব্যস্ত। ওদিকে এক মাস আগে আপুর ছেলের জন্ম হয়েছে, ছোট বাচ্চা, আপুও সময় দিতে পারছে না। কাজিন আর মামা আছেন। সবাই দৌড়াচ্ছে। রক্ত জোগাড় করছে, সবাই ব্যতিব্যস্ত। আর আমি একা বসে ব্লগে কবিতা লিখছি-

কবিতা নয় অস্তিরতা প্রশমনের চেষ্টা///
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ সকাল ১১:৩৯ |

বাবার জন্যে অস্তিরতা
------------------
গুমোট অস্থিরতা রুখতে শব্দ ভান্ডারে মুখ গুজে খুঁজি শব্দ
বাক্যের পর বাক্য গড়ার প্রচেষ্টায় গড়তে চাই আসলে হয়তো
কবিতার ফাঁদ যে ফাঁদে বাতাস থাকবেনা, থাকবেনা মধ্যকর্ষন,
কান্নার বারি ঝরবেনা, পড়বেনা ত্বকের ভাজ, জড়োসড়ো হয়ে
বসে থাকব একাকী ফাঁদের নির্জনে আর চোখ বুজে চলে যাব
বহুদূরে হাসপাতালে ঢাকায় মুমূর্ষু বাবার শয্যালীন শয্যার পাশে
শব্দ বাক্যে গড়া কবিতার ফাঁদে আমি নির্জনতার প্রতিদান ভুগি,
আশায় বুক বাধি, বেদনার সুর কাটি আর অস্থিরতার কাছে চাই
সাময়িক ছুটি কেউ ছুটি দেয়না-- কি কল্পনা কি বাস্তব
নির্জন নির্বাসন কে ভালবাসার এই তো প্রবল প্রতিদান বাবার
অসুস্থ শিশুর মত মুখ খানি বারবার ভেসে ওঠে, উঠতেই থাকে,
থাকবে দৃষ্টির দূরত্ব না ঘোচা অবধি অস্তিরতা শব্দ আর বাক্যে
কিছু সময় হয়তো নিজেকে নিজের মাঝে ছাই চাপা দিতে পারে ,
পারেনা বায়ু হীন , মধ্যকর্ষন হীন একটি কবিতার ফাঁদ গড়তে
রক্তের টান ফাঁদ কেনো মানবে, সেখানে যে অস্থিরতার অবাধ গতি

তখনও জানি না কয়েক ঘন্টা পরেই জীবন কত কঠিন।
সেই একটা দিন, একটা রাত কি নিদারুন কেটেছে। মাত্র একদিন আগে ঢাকা থেকে এসেছি। তবুও বলছি বারবার , আমার কি আসতে হবে? আম্মু বলছে, না রক্ত দেয়া হয়েছে কয়েক ব্যাগ, দেখা যাক। তবুও কেউ বলছে না, পায়খানার পথে অবিরাম রক্ত যাচ্ছে। তবুও কেউ বলছে না আর সময় নেই। আব্বুর অবস্থা সত্যিই সে মারাত্মক খারাপ এটা আমাকে জানানো হলো পরদিন সকালে।
১২ই ফেব্রুয়ারি সকাল। কক্সবাজার হতে ঢাকা গামী সকালের সব বাসই ১০/১১ টার মধ্যে ছেড়ে চলে যায়। এরপর আর বাস পাওয়া সম্ভব নয়। বাস পাবার সম্ভাবনাময় সময় পেরিয়ে গিয়েছিল। আমি আমার ইমিডিয়েট বস এর কাছ থেকে ঢাকা যাবার কোন অনুমতিই পাচ্ছিলাম না। বারবার ঢাকায় ফোন করছিলাম। আম্মুর এক কথাই, পারলে চলে আয়। তাও কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে। আমি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলাম আমার সেই বসের উপর। উনি বলছিলেন, ‘বাসা থেকে একটু বাড়িয়েই বলে, আমাকেও ইমার্জেন্সি কল করে বাসায় ডাকল একবার, গিয়ে দেখি মা ঠিকই সুস্থ।’  ষ্টেশনে তখন আমি একা। তিনিও ঢাকায়। ষ্টেশন ছেড়ে যাবা ঠিক হবে না, তিনিও তার লজিকে ঠিক আছেন। কিন্তু আমি তো যাবই। সারাজীবনই নরম মানুষ কর্মক্ষেত্রে। বাবার শেষ অবস্থা, এই সময় আর নরম থাকলে কি হবে! বসের উর্ধ্বতন বসকে ফোন দিয়ে বসলাম। অমায়িক মানুষ। স্যারের নাম মনে পড়ছে না কেনো। এই এক সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের নাম হঠাৎ করেই আমার কণ্ঠে এসে আটকে যায়। চেষ্টা করে দেখি এবিসিডি পদ্ধতিতে নামটি মনে আসে কিনা। ‘এ’ তারপর ‘এ’ অক্ষরে যত নাম মনে আসে মিলাতে থাকি। তারপর ‘বি’ অক্ষরে যত নাম। এভাবে এগোতে এগোতে প্রযোজনীয় নামটি সামনে চলে আসতেও পারে। এ গেলো, না , বি গেলো , না ...সি,ডি,ই,এফ,জি, এইচ...এইতো মনে পড়েছে হারুণ স্যার। এখন উনি বিটিসিএল এর জিএম হয়েছেন। স্যারকে বিস্তারিত বললাম। আমার গলার টোন শুনেই উনি হয়তো অনুধাবন করতে পারলেন বিষয় সিরিয়াস। সাথে সাথে অনুমতি দিলেন। বললেন, এক্ষুনি চলে যাও, কিন্তু কিভাবে যাবে? আমি বললাম, ফোনে খোঁজ নিয়েছি, আড়াইটায় জিএমজির প্লেন আছে ঢাকা গামী। স্যার বললেন, কোন কিছু না ভেবেই ওতেই চলে যাও।
আমি দেরী করি নি। লোক পাঠিয়ে জিএমজির প্লেনের টিকেট আনালাম। দ্রুত রেডি হলাম। সেদিনের সেই প্লেনের টিকেট না হলে হয়তো বাবার মুখটি শেষ কখনই আর দেখা হতো না। হারুন স্যারের কাছে আমি ঋণী, আমি ঋণী সেদিনের সেই জিএমজি বিমানের কাছেও। লাঞ্চ না করেই গিয়ে প্লেনে উঠলাম। প্লেনের দুটো পিস কেকই হলো কেবল দুপুরের খাবার। আমি ঢাকা এযারপোর্ট থেকে রওয়ানা দিয়ে সম্ভবত ৪টা নাগাদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে গিয়ে পৌছেছিলাম।
...সামনে বিছানায় শুয়ে আছেন প্রায় নিথড় যে লোকটি তিনি আবার বাবা। স্যালাইন দেয়া, মুখে অক্সিজেন সিলিন্ডার। আমি খুবই শক্ত মানুষ, তবুও মনে মনে কেমন একটা ধাক্কা খেলাম।  আম্মা তখন অনেকটা শক্ত হয়েছেন দেখলাম। বললেন, ভাত আছে খেয়ে নে। চেষ্টা করলাম, এক দু মুঠোর বেশি ঢুকলোনা।
তারপর আব্বার পাশে বসি কখনও। কখনও পাখা দিয়ে বাতাস করি। কখনও অক্সিজেন মাক্সটি ধরে রাখি। সন্ধ্যার দিকে কেবল একবার মাত্র চোখ খুলেছিলেন, আপুর এসেছিল তখন। যদিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগেই আপু চলে যেতে বাধ্য হযেছিল। নভ তখন মাত্র এক মাসের শিশু। সেই একবার চোখ খোলার সময় ঠিক সামনে ছিলাম আমি। তাকালেন আমার দিকে। এক পলকেই যেন নীরবে আমাকে বিশাল দায়িত্ব অর্পণ করে দিলেন, বলে দিলেন কত কথা।  নীরবতার বাইরেও ছিল। তিনি মুখও খুললেন, কেবল দুটি শব্দ, আমার উদ্দেশ্যেই- ‘তুই এসেছিস?’ তারপর আবার নিশ্চুপ। বন্ধু মান্না আর মামুন এসেছিল। ওদের সাথে একটু বাইরে হাঁটতে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পরই আসল সেই কঠিন সময়। ডাক্তার ইতিমধ্যে এসে বলে গেছেন, আর হবে না, এনিটাইম ক্যান এক্সপায়ার। আম্মু কাঁদতে শুরু করেছেন।
তখন ঘড়িতে রাত আটটা। আমি আব্বুকে ধরে আসি। পরণের লু্িঙ্গ রক্তে জবজবে হয়ে গেছে। সম্ভবত উনি আমার হাতের উপরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সোহরাওয়ার্দীর তৎকালিন রেসিডেন্ট সার্জেন্ট ডঃআামজাদ হোসেন আমার দুঃসম্পর্কের মামা। ওনাকে ডাকা হলো। ডাক্তারী পদ্ধতিতে কনফার্ম হলাম আমার আব্বু, আমার জন্মদাতা লোকটি এই পৃথিবীতে আর নেই। আম্মু কাঁদছে। আমি আম্মুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝরঝর করে  চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল আমারও। আমি একটু পরেই পানি মুছলাম। প্রচন্ড শক্ত হয়ে গেলাম মুহূর্তে। আমাকে অনেকগুলো কাজ করতে হবে। অনেক কাজ। আমি সে সব কাজে নেমে পড়লাম। ডাক্তার মামার কাছ থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নেয়ার সময় মামা বলছিলেন, ‘মামুন তো বেশ শক্ত। খুব ভালো।’
আসলেই কি শক্ত! আব্বুর লাশ গাড়ীতে উঠানোর সময় দুহাতে রক্তে ভরে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় গাড়ীতে আব্বুর লাশের পাশে বসে কতকিছু ভাবছি, একটু পরে জানাজা, তারপর সেই সাতক্ষীরায় নিয়ে যেতে হবে। আমি কাঁদতে পারছিলাম না। আমি যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, কেবল দায়িত্ব পালন করতে হবে, অনেক দায়িত্ব, আমি যেন এক মেশিন তখন।
...তেমন কিছু করতে পারি নি। তিন তলা কম্পিলট করতে পেরিছে, বিয়েটাও করতে পেরেছি। আম্মুর প্রতি তেমন খেয়াল রাখতে পারি না তেমন একটা সময়রে অভাবে। তবুও সাত বছর পরে যেন চোখটা ভিজে উঠছে এই গভীর রাতে। হয়তো এই লেখাটা আরও অনেক আগেই লেখার দরকার ছিল।
আব্বু এক সময় খুলনাতে পোষ্টেড ছিলেন। তা ১৯৮৬/৮৭ সালের দিকে। আমাকে, সেই ছোট্ট আমাকে খুলনা থেকে চিঠি লিখতেন। চিঠিতে স্ব লিখিত ছড়া থাকত। তার কিছু আমি বাসায় খুঁজে পেয়েছি। তারই একটি ছড়া যাআমার জন্য, কেবল আমার জন্যই লিখেছিলেন-
  খোকার মান ভাঙলো
খোকন সোনার মুখ ভার,
মন বসেনা খেলায় তার।
খেলনা পুতুল বল কই,
নাই যে তার গল্পের বই।
মন ভাঙাতে আনলো মামা,
সুন্দর একটা লাল জামা।
জামা চায় না চায় বল,
কান্নায় আসে চোখে জল।
হঠাৎ আব্বু এলেন বাড়ী,
নিয়ে খেলনা মোটর গাড়ী।
খোকন সোনা হইলো খুশি,
গোমড়া মুখে ফুটলো হাসি।

বাবার অনেক আগের একটি ছবি ( কোলে আমার বড় আপু)

...বাবার কবর সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায়। বাবাই সেখানে কবর দিতে বলে গিয়েছিলেন। অনেকদিন যাওয়া হয় না। আমার ছোট্ট মেয়েটা কখনই যায়নি। গত ডিসেম্বর মাসে যাবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সাতক্ষীরা এলাকায় যে সহিংসতা দেখছিলাম রোজ রোজ সে সময়, সাহস পাইনি। হয়তো যাব, নিকট ভবিষ্যতেই। হয়তো বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে মেনে নিতে চাইবো তিনি আর আমাদের মাঝে সত্যি নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন