(এই লেখাটি 'মেঘফুল' ছোট কাগজের এপ্রিল ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)
পহেলা বৈশাখ তথা বঙ্গাব্দের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শাসক দাউদ খান কাররানির মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা সম্পূর্ণ রূপে সুবাহ হিসেবে মুঘল শাসনের অধীনস্থ হয়, দিল্লীর মসনদে তখন ক্ষমতায় সম্রাট আকবর (শাসনকাল ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ হতে ১৬০৫ খৃষ্টাব্দ)। সে সময় প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে কৃষি ও ভূমি কর বা খাজনা আদায় হতো ইসলামি হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাতেও তাই। অথচ কৃষিকাজ সম্পাদিত হয় সৌরবর্ষ তথা সৌরমাসের হিসেবে। কিন্তু হিজরী সন নির্ভরশীল হলো চাঁদের উপর, সঙ্গত কারণেই কর আদায় আর কৃষি ফলনের সময় সংগতিপূর্ণ হচ্ছিল না। চন্দ্রবর্ষ সম্পূর্ণ হয় ৩৫৪ দিনে আর সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে। সে কারণে ৩১ চন্দ্র বছর হলো ৩০ সৌর বছরের সমান। আকবরের বিশিষ্ট মন্ত্রী এবং বিজ্ঞ সভাসদ আবুল ফজল একদিন সম্রাাটকে একান্তে এই বাস্তবতা বোঝালেন। সম্রাট আকবর বিষয়টি অনুধাবন করলেন এবং এই গরমিল থেকে সরে আসার জন্য প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সম্রাটের আদেশে নবরত্নসভার বিশিষ্ট একজন এবং তৎকালীন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি চান্দ্রমাস নির্ভর হিজরী বর্ষপঞ্জি এবং সৌরমাস নির্ভর হিন্দু বর্ষপঞ্জি গবেষণা করে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি প্রস্তাব করেন। সে মতে সম্রাট ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ (৯৯২ হিজরী সনে) একটি ফরমান জারি করেন এবং নতুন বর্ষপঞ্জি প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেয়া হয় তারিখ-ই-ইলাহী। তবে ঐ ফরমানে বলা হয় নতুন এই পদ্ধতি কার্যকর ধরা হবে পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের ঐতিহাসিক দিনটি থেকে। দিনটি হলো ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ ( ১০ ই রবিউল আউয়াল ৯৬৩ হিজরী) ।
ঐ ফরমানে আরও উল্লেখ ছিলো ৯৬৩ হিজরীর প্রথম মাস অর্থাৎ মহররম মাসের সমসাময়িক সময়ই নতুন বর্ষ পঞ্জির ৯৬৩ তম বছরের প্রথম মাস ধরা হবে। সে সময় প্রচলিত ভারতীয় পুরাতন বর্ষপঞ্জি ‘শকাব্দ’ অনুসারে মহরম মাসের সমসাময়িক মাস ছিল বৈশাখ এবং ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ (বর্তমানে প্রচলিত ইংরেজী বর্ষপঞ্জি) অনুযায়ী মাস ছিল এপ্রিল। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই এপ্রিল নতুন বর্ষপঞ্জির (ধরে নেয়া যায়, বঙ্গাব্দের) ৯৬৩ বর্ষের ১লা বৈশাখ ধরা হলো। এভাবে আকবর একটি কেন্দ্রীয় ইলাহি সন তৈরী করিয়েছিলেন, অনুমান করা যায় এই ইলাহী সন বাস্তবায়নের ফরমান অনুসারেই একই কাঠামো বজায় রেখে বাংলা সন চালু হয়। আকবর তার তারিখ-ই-ইলাহী অনুসারে যেসব আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন (উড়িষ্যার আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি) তাদেরকে বলা হয় ‘ফসলি সন’। বাংলা সনও তেমনি একটি ‘ফসলি সন’ যা পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করা হলেও এর গঠন-পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের (শকাব্দ অথবা শালীবাহনাব্দ হল ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলপ্রচলিত এক প্রাচীন সৌর অব্দ। এই অব্দ বঙ্গাব্দের ৫১৫ বছর পূর্বে এবং খৃষ্টাব্দের ৭৮ বছর পরে প্রচলিত হয়) মতো, তবে এটি শকাব্দের সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকু যে, এর মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। শকাব্দ অনুযায়ী বছরের প্রথম মাস ছিল চৈত্র। আর বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। বাংলা সন প্রকৃতপক্ষে একেবারেই স্বকীয়। আমাদের এ অঞ্চলে ২৪টির মতো সন ছিল। সেসব সন রাজা-বাদশাহ, ধর্ম বা সীমিত অঞ্চলের কিন্তু বাংলা সন বাংলাদেশ ও জাতির নামে।
হিজরী এবং বঙ্গাব্দ ৯৬৩ সনে একই বছর ধরলেও বর্তমানে সময়ে (১৪২১ বঙ্গাব্দ এবং ১৪৩৫ হিজরী) আরবী এবং বাংলা সনের পার্থক্য ১৪ বছরের মত। এর মূল কারণ চন্দ্র বর্ষ সৌর বর্ষ হতে ১১ দিন কম। কিন্তু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের পার্থক্য এখনও একই (৫৯৩ বছর), কারণ দুটোই সৌরবর্ষ অনুসরণ করে থাকে।
১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিল কে বঙ্গাব্দের ৯৬৩ তম বছরের ১ লা বৈশাখের সূচনা ধরলে বঙ্গাব্দের প্রথম বছরের হিসেব শুরুর সময়কাল হয় ৫৯৩ খৃষ্টাব্দ। এই কারণে বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কিত একটি মতে প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খৃষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক ভারতের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অধিকাংশ তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনুমান করা হয় যে জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের সোমবার ১২ এপ্রিল ৫৯৪ এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সোমবার ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা ও শকাব্দ অনুসারে বাংলা বারটি মাসতো আগে থেকেই পালিত হতো।
পহেলা বৈশাখের দিন নির্ণয় ব্যবস্থাঃ
সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে- বরাহমিহির ৫৫০ খৃৃষ্টাব্দের দিকে পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার পাঁচটি খণ্ডের নাম সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত ও ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত। এই গ্রন্থটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীন ভারতে দিন, মাস, বৎসর গণনার ক্ষেত্রে 'সূর্যসিদ্ধান্ত' একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে সৌর-মাস নির্ধারিত হয় সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। তারা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন যার একটি ভাগকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন এক একটি রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হলো- মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন। সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে ‘সংক্রান্তি’ বলা হয়। এই বিচারে এক বছরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। এক একটি সংক্রান্তিকে এক একটি মাসের শেষ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে তার পরদিনই ১ বৈশাখ (পহেলা বৈশাখ) হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয় তার পরদিনই মাসের প্রথম দিন। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়। লক্ষ্য করা যায় সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগতে পারে ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন। সেই কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা সমান হয় না। এই সনাতন বর্ষপঞ্জী অনুসারে বছর ঋতুভিত্তিক থাকে না। একেকটি মাস ক্রমশঃ মূল ঋতু থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে। ভারতে প্রচলিত সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে বঙ্গাব্দের সূর্য যখন মেষ রাশিতে অবস্থান করে তথন হয় বৈশাখ মাস, এই মাসের ব্যপ্তি হতে পারে ৩০ বা ৩১। শকাব্দ এবং বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। বৈশাখ নামটি এসেছে বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে।
সংস্কারকৃত বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে- বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের প্রস্তাবনা প্রদান করেন। বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে। এ প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছরের ফেব্র“য়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয় এবং ঐ বর্ষকে অধিবর্ষ বলা হয়। (ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দীতে যে শতাব্দীকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না বা বিভাজ্য নয়।) জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই পূর্বে অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি। বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের ছিল। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে কমিটি বাংলা একাডেমীর কাছে কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করে। সে প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমানে---
নববর্ষ উদযাপন এবং পহেলা বৈশাখঃ
নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস অনেক পুরনো। পারস্যের ১১ দিনব্যাপী ‘নওরোজ’ পালিত হয় প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে থেকে। ব্যবিলনে নববর্ষ উৎসব উদযাপন হতো প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগেও। রোমানরা অনেক আগেই বসন্তকালের নববর্ষ উৎসব উদযাপন শিখেছিল ব্যবিলনীয়দের কাছ থেকে। ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব ‘রাশ হুশনা' পালন করতো খ্রিষ্ট জন্মের অনেক আগ থেকেই। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান জগতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ১লা জানুয়ারি Happy new year পালিত হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। হিজরি নববর্ষ উৎসবের কোন আড়ম্বরতা না থাকলেও আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপিত হচ্ছে মাত্র কয়েক শতক ধরে।
হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি ব্যাপক উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত।
সম্রাট আকবরের সময় কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয় বলে মনে করা হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানের আধুনিক পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা হলো আসলে একটি নতুন হিসাব বই। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
সম্রাট আকবরের সময় থেকে নওরোজ বা নববর্ষ পালনের ধারাবাহিকতায় ১৬০৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীররে নির্দেশে সুবদোর ইসলাম খা চিশতি ঢাকাকে যখন রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলেন, তখন থেকেই রাজস্ব আদায় ও ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য বাংলা বছররে পহেলা বৈশাখকে উৎবের দিন হিসেবে পালন শুরু করনে। ঐতিহাসিক তথ্যে আছে যে, সম্রাট আকবরের অনুকরণে সুবদোর ইসলাম চিশতি তার বাসভবনরে সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং বৈশাখ উৎসব পালন করতনে। সেখানে সরকারি সুবদোর হতে শুরু করে জমিদার, কৃষক ও ব্যবসায়ীরা উপস্থতি থাকত। প্রজারা খাজনা নিয়ে আসত সেই উপলক্ষে সেখানে খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি চলত মেলায় গান-বাজনা, গরু-মোষের লড়াই, কাবাডি খেলা ও হালখাতা অনুষ্ঠান। পরবর্তীতে ঢাকা শহরে মিটর্ফোডরে নলগোলার ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ি, বুড়িগঙ্গার তীরর্বতী ঢাকার নবাবদের আহসান মঞ্জিল, ফরাসগঞ্জ এর রূপলাল হাউস, পাটুয়াটুলীর জমিদার ওয়াইযের নীলকুঠির সামনে প্রতি পহলো বৈশাখে রাজ পুন্যাহ অনুষ্ঠান হতো। প্রজারা নতুন জামাকাপড় পরে জমিদারবাড়ি খাজনা দিতে আসত। জমিদাররা আংগীনায় নেমে এসে প্রজাদের সাথে কুশল বিনিময় করতেন। সবশেষে ভোজর্পব দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হতো।
আধুনিক বাংলা নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। তাছাড়া ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় বর্তমান শরীয়তপুর জেলার কার্তিকপুর গ্রামের এক মহাজন মজুদদার খাদ্য গুদামজাত করে রাখে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। ব্রিটিশ সরকারের তাঁবেদারকে উৎখাত করতে ঐক্যবদ্ধ হয় বাংলার যুব সমাজ। এই ঘটনার আলোকে যাত্রাপালা ‘আকালের দেশ’ ওই কার্তিকপুরেই মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৪৪ সালে অর্থাৎ ১৩৫১ বাংলা সালের পহেলা বৈশাখে। বাঙালিত্বের চেতনার তীব্র্র চাপে ১৯৬৪ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে যখন বাংলা সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে তখন পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই ‘ছায়ানট’ ১৯৬৭ সালের ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, বাংলা ১৩৭৪ সন) রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে। বস্তুত এই দিনটি থেকেই ‘পহেলা বৈশাখ’ বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম এক পরিচায়ক রূপে আবির্ভূত হয়। ১৯৭২ সালে (বাংলা ১৩৭৯ সন) ‘পহেলা বৈশাখ' বাংলাদেশের জাতীয়’ পার্বন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ২১ এ ফেব্র“য়ারির মতোই থামিয়ে দিতে চেয়েছে বৈশাখের উদযাপন।। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাংলায় (বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গ) পূজা, উৎসব পার্বণ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সামজিক অনুষ্ঠানগুলো এখনো বাংলা বর্ষপঞ্জি নির্ভর। শহুরে মানুষরা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সাম্প্রতিক কালে পহেলা বৈশাখকে একটি সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের রূপ দিতে সচেষ্ট এবং অনেকখানি সফলও বলা যায়।
পহেলা বৈশাখ এবং প্রাণের উৎসব:
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন- নববর্ষের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সম্পর্ক বেশ নিবিড়। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয়জন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়, বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটমুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। বিশেষ খাবারে মধ্যে পান্তা ভাত ও ইলিশের একটা আলাদা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়ে গেছে। এ দিন কয়েকটি গ্রামের মিলন স্থানে খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। এই দিনে পুরানো প্রথা অনুযায়ী নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তি, কাবাডি, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই এসব খেলার ও আয়োজন থাকে। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে আলোচিত আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রাম-এর লালদিঘী ময়দান-এ যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে (প্রকৃতপক্ষে অশ্বত্থ গাছ ) পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে বর্ষবরণ। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের আরেকটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। বাংলা একাডেমীসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বসে চারু ও কারুশিল্প মেলা।
সোনারগাঁয় ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে শুরু হওয়াা এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ‘ঘোড়ামেলা’।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল কেন্দ্র বর্তমানে ডিসি পাহাড় পার্ক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এখানে পুরোনে বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য দুইদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থবকে নানা গ্রামীণ পন্যের পশরা। থাকে পান্তা ইলিশের ব্যবস্থাও। চট্টগ্রামে সম্মিলিত ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যোগ ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিকগণের চেষ্টায়। ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োাজিত হয়। ১৯৭৮ সালে এই উৎসাব এখনকার ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেওয়া হয়। নগরীর অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিশু সংগঠন ফুলকীর তিনদিন ব্যাপী উৎসব যা শেষ হয় বৈশাখের প্রথম দিবসে। নগরীর মহিলা সমিতি স্কুলে একটি বর্ষবরণ মেলাও হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বা রয়েছে যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বর্ষবরণ উৎসব। ত্রিপুরাদের বৈশুক, বৈসু বা বাইসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিস্বত্ত্বা একত্রে এই উৎসবটি পালন করে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। তাছাড়া মার্মাদের পানি উৎসবটি প্রতিটি এলাকাতেই কমবেশি জনপ্রিয়। এটিও বৈসাবী উৎসবেরই একটি অংশ।
পশ্চিমবঙ্গে পয়লা বৈশাখ উদযাপন- (পশ্চিম বঙ্গে পহেলা বৈশাখ না লিখে পয়লা বৈশাখ লেখা হয়) পশ্চিমবঙ্গেও মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুবসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। এছাড়া বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান সেরে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি বহুলপ্রচলিত। বাড়িতে বাড়িতে এবং সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে, যার পোশাকি নাম হালখাতা। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেয়া হয় বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম ‘চৈত্র সেল’। পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এইদিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত।
পরিশিষ্টঃ
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় পহেলা বৈশাখ এবং বর্ষবরণ উৎসব এতো আড়ম্বর রূপ পায় নি ঠিকই, তথাপি তখনও যে প্রাণে প্রাণে বৈশাখের তথা নতুন বছরের তীব্র আকুতি আর উচ্ছাস ছিলো তাতার কালজয়ী সেই গানে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই-
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্র“বাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করে দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাখ
মায়ার কুজ্ঝটিকাজাল যাক দূরে যাক।’
‘বৈশাখের প্রথম জলে আশুধান দ্বিগুন ফলে’ অথবা ‘মাঘে মুখী, ফাল্গুনে চুখী, চৈত্রে লতা, বৈশাখে পাতা’- বৈশাখ নিয়ে খনার এইসব বচন আমাদের কাছে প্রাচীন বাংলাতেও বৈশাখের গুরুত্ব স্পষ্ট করে। অতীতের সেই গুরুত্বপূর্ন বৈশাখের প্রথম দিন ‘পহেলা বৈশাখ’ নামে হয়ে উঠেছে আজ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহদাকার এবং জাতীয় উৎসব।
কৃষিভিত্তিক গ্রাম থেকে উদ্ভূত এই উৎসব আজ শহরে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং নতুন নতুন মাত্রা লাভ করে বিশাল এক অসাম্প্রদায়িক আনন্দ মেলার আকার নিয়েছে। গ্লোবাল ভিলেজের কারণে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে পূর্বের সেই বাংলা সন ভিত্তিক হিসাব ব্যবস্থা এখন প্রায় সম্পূর্ণ গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি নির্ভর হয়ে পড়েছে। যার ফলে ষাট বা সত্তুর দশকেও যে হালখাতা দেখা যেতো উৎসবের মতো করে, তা দিনে দিনে ফিকে হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে। মূলত পহেলা বৈশাখ এখন আর কেবল হালখাতা নির্ভর অনুষ্ঠানমাত্র নয়, বরং অনেক ব্যাপক, দূরসঞ্চারী এবং বহুমাত্রিকতায় পূর্ণ আমাদের অন্যতম জাতীয় উৎসব। প্রায় প্রতি নববর্ষেই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা, বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসমাগম, এবং উৎসাহের জোয়ার। পাশ্চাত্যের বর্ষবরণের আদলে আমাদের দেশেও বর্তমানে কার্ড আদান প্রদানের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়, সংগীত-নৃত্যের মাধ্যমে প্রাণে গতিসঞ্চার এবং সর্বশেষ ফোন সংস্কৃতির মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ ও ফেসবুকীয় শুভেচ্ছা বিনিময় এ ক্ষেত্রে নবতর ধারার সূচনা করেছে। তবে বিবর্তনের ধারায় আমাদের দেশের সংস্কৃতি মিশ্রসংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হলেও বাঙালির নিজস্বতা একেবারে বিলীন হয়নি। আজও পহেলা বৈশাখের সঙ্গে বাঙালির আদি সংস্কৃতি যেমন, যাত্রা ও পালা, কবিগান, গাজির গান, আলকাপ, পুতুল নাচ, বাউল-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি গান, লাইলি-মজনু, রাধা-কৃষ্ণ, ইউসুফ-জুলেখা ইত্যাদি পালা প্রদর্শনের আয়োজন করা হয় প্রত্যন্ত গ্রামে।
নববর্ষ উৎসব পালনের ধরন নিয়ে অনেক বিরূপ মন্তব্যও শোনা যায়। কেউ কেউ এর মধ্যে বিজাতীয় বা বিধর্মীয় ঐতিহ্যের গন্ধ খুঁজে পান। কিন্তু যেভাবেই পালিত হোক, পহেলা বৈশাখ বাঙালীর ঐতিহ্যেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি তার জাতিসত্তাকে অনুভব করে, ফিরে আসে শেকড়ের কাছে এবং সমাবেত হয় মহামিলনের মেলায় এই পহেলা বৈশাখেই।
তথ্য সূত্রঃ
১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শাসক দাউদ খান কাররানির মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা সম্পূর্ণ রূপে সুবাহ হিসেবে মুঘল শাসনের অধীনস্থ হয়, দিল্লীর মসনদে তখন ক্ষমতায় সম্রাট আকবর (শাসনকাল ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ হতে ১৬০৫ খৃষ্টাব্দ)। সে সময় প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে কৃষি ও ভূমি কর বা খাজনা আদায় হতো ইসলামি হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাতেও তাই। অথচ কৃষিকাজ সম্পাদিত হয় সৌরবর্ষ তথা সৌরমাসের হিসেবে। কিন্তু হিজরী সন নির্ভরশীল হলো চাঁদের উপর, সঙ্গত কারণেই কর আদায় আর কৃষি ফলনের সময় সংগতিপূর্ণ হচ্ছিল না। চন্দ্রবর্ষ সম্পূর্ণ হয় ৩৫৪ দিনে আর সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে। সে কারণে ৩১ চন্দ্র বছর হলো ৩০ সৌর বছরের সমান। আকবরের বিশিষ্ট মন্ত্রী এবং বিজ্ঞ সভাসদ আবুল ফজল একদিন সম্রাাটকে একান্তে এই বাস্তবতা বোঝালেন। সম্রাট আকবর বিষয়টি অনুধাবন করলেন এবং এই গরমিল থেকে সরে আসার জন্য প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সম্রাটের আদেশে নবরত্নসভার বিশিষ্ট একজন এবং তৎকালীন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি চান্দ্রমাস নির্ভর হিজরী বর্ষপঞ্জি এবং সৌরমাস নির্ভর হিন্দু বর্ষপঞ্জি গবেষণা করে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি প্রস্তাব করেন। সে মতে সম্রাট ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ (৯৯২ হিজরী সনে) একটি ফরমান জারি করেন এবং নতুন বর্ষপঞ্জি প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেয়া হয় তারিখ-ই-ইলাহী। তবে ঐ ফরমানে বলা হয় নতুন এই পদ্ধতি কার্যকর ধরা হবে পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের ঐতিহাসিক দিনটি থেকে। দিনটি হলো ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ ( ১০ ই রবিউল আউয়াল ৯৬৩ হিজরী) ।
ঐ ফরমানে আরও উল্লেখ ছিলো ৯৬৩ হিজরীর প্রথম মাস অর্থাৎ মহররম মাসের সমসাময়িক সময়ই নতুন বর্ষ পঞ্জির ৯৬৩ তম বছরের প্রথম মাস ধরা হবে। সে সময় প্রচলিত ভারতীয় পুরাতন বর্ষপঞ্জি ‘শকাব্দ’ অনুসারে মহরম মাসের সমসাময়িক মাস ছিল বৈশাখ এবং ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ (বর্তমানে প্রচলিত ইংরেজী বর্ষপঞ্জি) অনুযায়ী মাস ছিল এপ্রিল। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই এপ্রিল নতুন বর্ষপঞ্জির (ধরে নেয়া যায়, বঙ্গাব্দের) ৯৬৩ বর্ষের ১লা বৈশাখ ধরা হলো। এভাবে আকবর একটি কেন্দ্রীয় ইলাহি সন তৈরী করিয়েছিলেন, অনুমান করা যায় এই ইলাহী সন বাস্তবায়নের ফরমান অনুসারেই একই কাঠামো বজায় রেখে বাংলা সন চালু হয়। আকবর তার তারিখ-ই-ইলাহী অনুসারে যেসব আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন (উড়িষ্যার আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি) তাদেরকে বলা হয় ‘ফসলি সন’। বাংলা সনও তেমনি একটি ‘ফসলি সন’ যা পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করা হলেও এর গঠন-পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের (শকাব্দ অথবা শালীবাহনাব্দ হল ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলপ্রচলিত এক প্রাচীন সৌর অব্দ। এই অব্দ বঙ্গাব্দের ৫১৫ বছর পূর্বে এবং খৃষ্টাব্দের ৭৮ বছর পরে প্রচলিত হয়) মতো, তবে এটি শকাব্দের সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকু যে, এর মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। শকাব্দ অনুযায়ী বছরের প্রথম মাস ছিল চৈত্র। আর বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। বাংলা সন প্রকৃতপক্ষে একেবারেই স্বকীয়। আমাদের এ অঞ্চলে ২৪টির মতো সন ছিল। সেসব সন রাজা-বাদশাহ, ধর্ম বা সীমিত অঞ্চলের কিন্তু বাংলা সন বাংলাদেশ ও জাতির নামে।
হিজরী এবং বঙ্গাব্দ ৯৬৩ সনে একই বছর ধরলেও বর্তমানে সময়ে (১৪২১ বঙ্গাব্দ এবং ১৪৩৫ হিজরী) আরবী এবং বাংলা সনের পার্থক্য ১৪ বছরের মত। এর মূল কারণ চন্দ্র বর্ষ সৌর বর্ষ হতে ১১ দিন কম। কিন্তু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের পার্থক্য এখনও একই (৫৯৩ বছর), কারণ দুটোই সৌরবর্ষ অনুসরণ করে থাকে।
১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিল কে বঙ্গাব্দের ৯৬৩ তম বছরের ১ লা বৈশাখের সূচনা ধরলে বঙ্গাব্দের প্রথম বছরের হিসেব শুরুর সময়কাল হয় ৫৯৩ খৃষ্টাব্দ। এই কারণে বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কিত একটি মতে প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খৃষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক ভারতের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অধিকাংশ তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনুমান করা হয় যে জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের সোমবার ১২ এপ্রিল ৫৯৪ এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সোমবার ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা ও শকাব্দ অনুসারে বাংলা বারটি মাসতো আগে থেকেই পালিত হতো।
পহেলা বৈশাখের দিন নির্ণয় ব্যবস্থাঃ
সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে- বরাহমিহির ৫৫০ খৃৃষ্টাব্দের দিকে পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার পাঁচটি খণ্ডের নাম সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত ও ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত। এই গ্রন্থটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীন ভারতে দিন, মাস, বৎসর গণনার ক্ষেত্রে 'সূর্যসিদ্ধান্ত' একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে সৌর-মাস নির্ধারিত হয় সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। তারা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন যার একটি ভাগকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন এক একটি রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হলো- মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন। সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে ‘সংক্রান্তি’ বলা হয়। এই বিচারে এক বছরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। এক একটি সংক্রান্তিকে এক একটি মাসের শেষ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে তার পরদিনই ১ বৈশাখ (পহেলা বৈশাখ) হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয় তার পরদিনই মাসের প্রথম দিন। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়। লক্ষ্য করা যায় সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগতে পারে ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন। সেই কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা সমান হয় না। এই সনাতন বর্ষপঞ্জী অনুসারে বছর ঋতুভিত্তিক থাকে না। একেকটি মাস ক্রমশঃ মূল ঋতু থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে। ভারতে প্রচলিত সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে বঙ্গাব্দের সূর্য যখন মেষ রাশিতে অবস্থান করে তথন হয় বৈশাখ মাস, এই মাসের ব্যপ্তি হতে পারে ৩০ বা ৩১। শকাব্দ এবং বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। বৈশাখ নামটি এসেছে বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে।
সংস্কারকৃত বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে- বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের প্রস্তাবনা প্রদান করেন। বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে। এ প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছরের ফেব্র“য়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয় এবং ঐ বর্ষকে অধিবর্ষ বলা হয়। (ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দীতে যে শতাব্দীকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না বা বিভাজ্য নয়।) জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই পূর্বে অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি। বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের ছিল। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে কমিটি বাংলা একাডেমীর কাছে কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করে। সে প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমানে---
- সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত পাঁচ মাস প্রতিমাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩০ দিন গণ্য করা হয়।
- প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে (গ্রেগরি ক্যালেন্ডারের অধিবর্ষে) অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করা হয় এবং তখন ফাল্গুন মাস হয় ৩১ দিনে।
- তাছাড়া পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না সূর্যদোয় থেকে থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যদোয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দ অর্থাৎ ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু হয়।
নববর্ষ উদযাপন এবং পহেলা বৈশাখঃ
নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস অনেক পুরনো। পারস্যের ১১ দিনব্যাপী ‘নওরোজ’ পালিত হয় প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে থেকে। ব্যবিলনে নববর্ষ উৎসব উদযাপন হতো প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগেও। রোমানরা অনেক আগেই বসন্তকালের নববর্ষ উৎসব উদযাপন শিখেছিল ব্যবিলনীয়দের কাছ থেকে। ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব ‘রাশ হুশনা' পালন করতো খ্রিষ্ট জন্মের অনেক আগ থেকেই। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান জগতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ১লা জানুয়ারি Happy new year পালিত হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। হিজরি নববর্ষ উৎসবের কোন আড়ম্বরতা না থাকলেও আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপিত হচ্ছে মাত্র কয়েক শতক ধরে।
হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি ব্যাপক উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত।
সম্রাট আকবরের সময় কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয় বলে মনে করা হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানের আধুনিক পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা হলো আসলে একটি নতুন হিসাব বই। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
সম্রাট আকবরের সময় থেকে নওরোজ বা নববর্ষ পালনের ধারাবাহিকতায় ১৬০৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীররে নির্দেশে সুবদোর ইসলাম খা চিশতি ঢাকাকে যখন রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলেন, তখন থেকেই রাজস্ব আদায় ও ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য বাংলা বছররে পহেলা বৈশাখকে উৎবের দিন হিসেবে পালন শুরু করনে। ঐতিহাসিক তথ্যে আছে যে, সম্রাট আকবরের অনুকরণে সুবদোর ইসলাম চিশতি তার বাসভবনরে সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং বৈশাখ উৎসব পালন করতনে। সেখানে সরকারি সুবদোর হতে শুরু করে জমিদার, কৃষক ও ব্যবসায়ীরা উপস্থতি থাকত। প্রজারা খাজনা নিয়ে আসত সেই উপলক্ষে সেখানে খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি চলত মেলায় গান-বাজনা, গরু-মোষের লড়াই, কাবাডি খেলা ও হালখাতা অনুষ্ঠান। পরবর্তীতে ঢাকা শহরে মিটর্ফোডরে নলগোলার ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ি, বুড়িগঙ্গার তীরর্বতী ঢাকার নবাবদের আহসান মঞ্জিল, ফরাসগঞ্জ এর রূপলাল হাউস, পাটুয়াটুলীর জমিদার ওয়াইযের নীলকুঠির সামনে প্রতি পহলো বৈশাখে রাজ পুন্যাহ অনুষ্ঠান হতো। প্রজারা নতুন জামাকাপড় পরে জমিদারবাড়ি খাজনা দিতে আসত। জমিদাররা আংগীনায় নেমে এসে প্রজাদের সাথে কুশল বিনিময় করতেন। সবশেষে ভোজর্পব দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হতো।
আধুনিক বাংলা নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। তাছাড়া ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় বর্তমান শরীয়তপুর জেলার কার্তিকপুর গ্রামের এক মহাজন মজুদদার খাদ্য গুদামজাত করে রাখে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। ব্রিটিশ সরকারের তাঁবেদারকে উৎখাত করতে ঐক্যবদ্ধ হয় বাংলার যুব সমাজ। এই ঘটনার আলোকে যাত্রাপালা ‘আকালের দেশ’ ওই কার্তিকপুরেই মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৪৪ সালে অর্থাৎ ১৩৫১ বাংলা সালের পহেলা বৈশাখে। বাঙালিত্বের চেতনার তীব্র্র চাপে ১৯৬৪ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে যখন বাংলা সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে তখন পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই ‘ছায়ানট’ ১৯৬৭ সালের ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, বাংলা ১৩৭৪ সন) রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে। বস্তুত এই দিনটি থেকেই ‘পহেলা বৈশাখ’ বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম এক পরিচায়ক রূপে আবির্ভূত হয়। ১৯৭২ সালে (বাংলা ১৩৭৯ সন) ‘পহেলা বৈশাখ' বাংলাদেশের জাতীয়’ পার্বন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ২১ এ ফেব্র“য়ারির মতোই থামিয়ে দিতে চেয়েছে বৈশাখের উদযাপন।। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাংলায় (বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গ) পূজা, উৎসব পার্বণ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সামজিক অনুষ্ঠানগুলো এখনো বাংলা বর্ষপঞ্জি নির্ভর। শহুরে মানুষরা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সাম্প্রতিক কালে পহেলা বৈশাখকে একটি সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের রূপ দিতে সচেষ্ট এবং অনেকখানি সফলও বলা যায়।
পহেলা বৈশাখ এবং প্রাণের উৎসব:
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন- নববর্ষের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সম্পর্ক বেশ নিবিড়। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয়জন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়, বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটমুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। বিশেষ খাবারে মধ্যে পান্তা ভাত ও ইলিশের একটা আলাদা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়ে গেছে। এ দিন কয়েকটি গ্রামের মিলন স্থানে খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। এই দিনে পুরানো প্রথা অনুযায়ী নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তি, কাবাডি, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই এসব খেলার ও আয়োজন থাকে। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে আলোচিত আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রাম-এর লালদিঘী ময়দান-এ যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে (প্রকৃতপক্ষে অশ্বত্থ গাছ ) পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে বর্ষবরণ। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের আরেকটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। বাংলা একাডেমীসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বসে চারু ও কারুশিল্প মেলা।
সোনারগাঁয় ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে শুরু হওয়াা এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ‘ঘোড়ামেলা’।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল কেন্দ্র বর্তমানে ডিসি পাহাড় পার্ক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এখানে পুরোনে বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য দুইদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থবকে নানা গ্রামীণ পন্যের পশরা। থাকে পান্তা ইলিশের ব্যবস্থাও। চট্টগ্রামে সম্মিলিত ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যোগ ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিকগণের চেষ্টায়। ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োাজিত হয়। ১৯৭৮ সালে এই উৎসাব এখনকার ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেওয়া হয়। নগরীর অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিশু সংগঠন ফুলকীর তিনদিন ব্যাপী উৎসব যা শেষ হয় বৈশাখের প্রথম দিবসে। নগরীর মহিলা সমিতি স্কুলে একটি বর্ষবরণ মেলাও হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বা রয়েছে যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বর্ষবরণ উৎসব। ত্রিপুরাদের বৈশুক, বৈসু বা বাইসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিস্বত্ত্বা একত্রে এই উৎসবটি পালন করে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। তাছাড়া মার্মাদের পানি উৎসবটি প্রতিটি এলাকাতেই কমবেশি জনপ্রিয়। এটিও বৈসাবী উৎসবেরই একটি অংশ।
পশ্চিমবঙ্গে পয়লা বৈশাখ উদযাপন- (পশ্চিম বঙ্গে পহেলা বৈশাখ না লিখে পয়লা বৈশাখ লেখা হয়) পশ্চিমবঙ্গেও মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুবসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। এছাড়া বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান সেরে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি বহুলপ্রচলিত। বাড়িতে বাড়িতে এবং সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে, যার পোশাকি নাম হালখাতা। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেয়া হয় বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম ‘চৈত্র সেল’। পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এইদিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত।
পরিশিষ্টঃ
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় পহেলা বৈশাখ এবং বর্ষবরণ উৎসব এতো আড়ম্বর রূপ পায় নি ঠিকই, তথাপি তখনও যে প্রাণে প্রাণে বৈশাখের তথা নতুন বছরের তীব্র আকুতি আর উচ্ছাস ছিলো তাতার কালজয়ী সেই গানে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই-
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্র“বাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করে দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাখ
মায়ার কুজ্ঝটিকাজাল যাক দূরে যাক।’
‘বৈশাখের প্রথম জলে আশুধান দ্বিগুন ফলে’ অথবা ‘মাঘে মুখী, ফাল্গুনে চুখী, চৈত্রে লতা, বৈশাখে পাতা’- বৈশাখ নিয়ে খনার এইসব বচন আমাদের কাছে প্রাচীন বাংলাতেও বৈশাখের গুরুত্ব স্পষ্ট করে। অতীতের সেই গুরুত্বপূর্ন বৈশাখের প্রথম দিন ‘পহেলা বৈশাখ’ নামে হয়ে উঠেছে আজ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহদাকার এবং জাতীয় উৎসব।
কৃষিভিত্তিক গ্রাম থেকে উদ্ভূত এই উৎসব আজ শহরে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং নতুন নতুন মাত্রা লাভ করে বিশাল এক অসাম্প্রদায়িক আনন্দ মেলার আকার নিয়েছে। গ্লোবাল ভিলেজের কারণে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে পূর্বের সেই বাংলা সন ভিত্তিক হিসাব ব্যবস্থা এখন প্রায় সম্পূর্ণ গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি নির্ভর হয়ে পড়েছে। যার ফলে ষাট বা সত্তুর দশকেও যে হালখাতা দেখা যেতো উৎসবের মতো করে, তা দিনে দিনে ফিকে হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে। মূলত পহেলা বৈশাখ এখন আর কেবল হালখাতা নির্ভর অনুষ্ঠানমাত্র নয়, বরং অনেক ব্যাপক, দূরসঞ্চারী এবং বহুমাত্রিকতায় পূর্ণ আমাদের অন্যতম জাতীয় উৎসব। প্রায় প্রতি নববর্ষেই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা, বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসমাগম, এবং উৎসাহের জোয়ার। পাশ্চাত্যের বর্ষবরণের আদলে আমাদের দেশেও বর্তমানে কার্ড আদান প্রদানের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়, সংগীত-নৃত্যের মাধ্যমে প্রাণে গতিসঞ্চার এবং সর্বশেষ ফোন সংস্কৃতির মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ ও ফেসবুকীয় শুভেচ্ছা বিনিময় এ ক্ষেত্রে নবতর ধারার সূচনা করেছে। তবে বিবর্তনের ধারায় আমাদের দেশের সংস্কৃতি মিশ্রসংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হলেও বাঙালির নিজস্বতা একেবারে বিলীন হয়নি। আজও পহেলা বৈশাখের সঙ্গে বাঙালির আদি সংস্কৃতি যেমন, যাত্রা ও পালা, কবিগান, গাজির গান, আলকাপ, পুতুল নাচ, বাউল-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি গান, লাইলি-মজনু, রাধা-কৃষ্ণ, ইউসুফ-জুলেখা ইত্যাদি পালা প্রদর্শনের আয়োজন করা হয় প্রত্যন্ত গ্রামে।
নববর্ষ উৎসব পালনের ধরন নিয়ে অনেক বিরূপ মন্তব্যও শোনা যায়। কেউ কেউ এর মধ্যে বিজাতীয় বা বিধর্মীয় ঐতিহ্যের গন্ধ খুঁজে পান। কিন্তু যেভাবেই পালিত হোক, পহেলা বৈশাখ বাঙালীর ঐতিহ্যেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি তার জাতিসত্তাকে অনুভব করে, ফিরে আসে শেকড়ের কাছে এবং সমাবেত হয় মহামিলনের মেলায় এই পহেলা বৈশাখেই।
তথ্য সূত্রঃ
- আকবর, রাহুল সাংকৃত্যায়
- AIN I AKBARI ( Volume II), by Abul Fazl Allami
- বাংলাদেশের ইতিহাস, মাহবুবুর রহমা
- http://chhayanaut.org
- http://wikipedia.org
- http://www.banglapedia.org/
- http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/5057
- ইন্টারনেটে প্রাপ্ত অন্যান্য আর্টিকেল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন