পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭

"পদ্মাবতী" এবং "খিলজী" -ঐতিহাসিক চরিত্র দুটির ভিত্তি

 ভণিতায় না গিয়ে সরাসির মূল বক্তব্যে প্রবেশ করলে সংক্ষিপ্ত ভূমিকাটা দাঁড়ায়- মূলত দুটি ঐতিহাসিক নাম স্পষ্ট করে  বোঝার জন্যই এ লেখাটির অবতারণা; একটি হলো "পদ্মাবতী" এবং অন্যটি "খিলজী"।

এই ইতিহাস অনুসন্ধানের পেছনে যে আলোচিত মেগা হিন্দি মুভি 'পদ্মাবতী' -র কিছুটা প্রভাব আছে তা বলোর অপক্ষা রাখলাম না।

১ম সংকট: 
 'পদ্মাবতী ' এই চরিত্রটির নাম আমি শুনেছি মূলত তিনটি সূত্রে। শৈশবে বাংলা সাহিত্যের জ্ঞান বৃদ্ধিকালে  উপমহাদেশের বিখ্যাত বাংলা কবি আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) এর লেখা কাব্য "পদ্মাবতী"  -র  ছন্দে প্রথম শুনেছিলাম পদ্মাবতী নামক অতি রূপবতী রাজকন্যা (এবং পরবর্তীতে রাণী) র নাম। বিটিভির হিরামন নামক রুপকথার নাটকেও চরিত্রটির নাম শুনেছিলাম।  এরপর ' মহারাণা প্রতাপ" নামে এক রাজপুত মহাবীর রাজার উপর নির্মিত হিন্দী সিরিয়ালে প্রতাপের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে শুনেছি তাদের এক প্রাচীন রাণী পদ্মাবতী-র জহর ( মানে দলবল সহ আগুনে আত্মাহুতির) নামক আত্মত্যাগের গৌরব কাহিনী।

আর ইদানীয়  পদ্মাবতী নামে মুভি নির্মাণ এবং তা নিয়ে ভারতে বেশ হৈচৈ হবার পর জানলাম মুভিটির কাহিনী   নেয়া হয়েছে ১৫৪০ খ্রি: মালিক মুহাম্মদ জয়সি নামক এক মহাকবির রচিত "পদ্মাবত" নামক কাব্যগ্রন্থ হতে।

সংকট নিরসনে ইতিহাস পাঠে জানতে পারলাম  উপরের সবগুলি 'পদ্মাবতী" একই চরিত্র।
আলাওলের "পদ্মাবতী" মালিক মোহাম্মদ জয়সির "পদ্মাবত" এর ই বাংলা অনুবাদ।
 ১৩০০ খ্রি: সময়কালে চিত্তরের  রাজা রতন সিংয়রে রাণী পদ্মিনী বা পদ্মাবতী অতি সৌন্দর্য্যের অধিকারিনী ছিলেন এবং দিল্লীর  সুলতান খিলজী তার প্রেমে পড়েছিলেন  তা ১৫৪০ সালের আগের কোন বর্ণিত ইতিহাসে ঠিক পাওয়া যায় না। সংগত কারণে ধরে নেয়া যায় ১৫৪০ সালে রচিত পদ্মাবত কাব্যেই ঐতিহাসিক এই মিথলোজিক্যাল চরিত্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু মিথ যেহেতু রঙিন হয়, মিথের পাখা থাকে, লোক মুখে সেটাই ইতিহাস হয়ে এগোতে থাকে বলেই পদ্মাবতী চরত্রিটির উপর লিখিত কাব্যের রূপকথাই ইতিহাস হয়ে এগিয়ে চলেছে। এই কাব্য কাহিনী অনুসারে দিল্লীর ততকালীন সুলতান খিলজী পদ্মাবতীকে পাওয়ার জন্য চিত্তর দূর্গ আক্রমন করেন এবং রাজা রতন সিং নিহত হন এবং পদ্মাবতী আগুনে আত্মাহুতি দেন  যদিও মূল ধারার ঐতিহাসিকগণ/ইতিহাস গবেষক গণ এ বক্তব্য অগ্রহনেযাগ্য মনে করেন বরং সম্রাজ্য ও আধিপাত্য বিস্তারকেই খিলজীর চিত্তর আক্রমনের কারণ হিসেবে মানেন।

২য় সংকটে যাবার আগে পদ্মাবতীর রূপের যে কাব্যিক বর্ণনা সুলতানের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল তা আলাওলের অনুবাদানুসারে :

পদ্মাবতী রূপ কি কহিমু মহারাজ।
তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুবন মাঝ ৷৷
আপানলম্বিত কেশ কস্তুরী সৌরভ ।
মহাঅন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব ৷৷
তার মধ্যে সীমান্ত খড়্গের ধার জিনি ।
বলাহক মধ্যে যেন স্থির সৌদামিনী ৷৷
স্বর্গ হন্তে আসিতে যাইতে মনোরথ ।
সৃজিল অরন্যমাঝে মহাসূক্ষ্ম পথ ৷৷
ভুরুর ভঙ্গিমা হেরি ভুজঙ্গ সকল।
ভাবিয়া চিন্তিয়া মনে গেল রসাতল ৷৷
কাননে কুরঙ্গ জলে সফরী লুকিত।
খঞ্জন-গঞ্জন নেত্র অঞ্জন রঞ্জিত ৷৷


২য় সংকট:

শৈশবের ইতিহাস পাঠ হতে একটি নাম আমার  মাথায় খুব চেপে বসে আছে। কারণ ঐ একটা লাইন ছিলো এমন -মাত্র ১৮জন সৈন্য নিয়ে ১২০৩খ্রি: লক্ষ্মণ সেন কে পরাজতি করে তৎকালীন বাংলা দখল করে নেন খর্ব আর্কৃতির আফগান যোদ্ধা  ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি (মৃত্যু- ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)। বখতিয়ার খিলজি বাংলা-বিহার অঞ্চলের ইতিহাসে বিশেষ করে মুসলীম ইতিহাসে এক অতি পরিচিত নাম। ১২০৪-১২০৬ খ্রি: পর্যন্ত বখিতয়ার খিলজী বাংলার শাসক ছিলেন এবং তার থেকেই বাংলায় মূলত মুসলীম শাসন আমল শুরু হয়।

সংকটের কারণ এই বখতিয়াার খিলজীর সাথে আমি পদ্মাবতীর কাহিনীর খিলজীকে মিলিয়ে ফেলছিলাম।
কিন্তু দু'জনর সম্পূর্ণ দুই ব‌্যক্তি। সম্পর্কের একটা যোগসূত্র আছে আর সেটা দু'জনেই আফগানিস্তানের একই এলকার 'খিলজী' গোত্রের ( মূলত মাইগ্রেটেড তুর্কী) । সরাসরি রক্তের সম্পর্ক বিদ্যমান কিনা সে তথ্য আমার জানা নেই।

পদ্মাবতির ইতিহাসে যে খিলজী চরিত্রটি রয়েছে তার ঐতিহাসিক ভিত্তি কাব্য অনুযায়ী এবং পরীক্ষিত ইতিহাস অুনযায়ীও একই রূপ- তিনি  ১২৯৬ খ্রি: থেকে ১৩১৬ খ্রি: পর্যন্ত দিল্লীর সুলতান ছিলেন। দিল্লীর মসনদে খিলজী ডাইনেস্টি রাজত্ব করে ১২৯০ খ্রি: থেকে ১৩২০ খ্রি: পর্যন্ত। খিলজী ডাইনেস্টির  দ্বিতীয় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন পরাক্রমশালী।  ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন খিলজি চিত্তর দূর্গ দখল করেন। আর পদ্মাবতী ছিলেন সেই দূর্গের রাণী ।


(সংযুক্ত ছবি সমূহ ইন্টারনেট হতে সংগৃহিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন