(চলমান)
১৮৮৯-১৮৯০খ্রি : রাশিয়ান ফ্লু::উৎপত্তি ১৮৮৯ এর মে মাসে উজবেকিস্তান ও কাজাখিস্তান এলাকা থেকে মনে করা হয়। দ্রুত এই মহামারী ছড়িয়ে পরে মস্কো , তারপর পোল্যান্ড ও ফিনল্যন্ড হয়ে পুরো ইউরোপ আর অক্টোবরে উত্তর আমেরিকায় । তাছাড়া ১৮৯০ এর মে মাসের মধ্যে দক্ষিন আমেরিকা, ভারতবর্ষ এবং অষ্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে পরে। সম্ভাব্য কারণ মনে করা হয় H3N8 ও H2N2 subtypes of the Influenza A virus কে।এক বছরেই সারা পৃথিবীতে এই মহামারীতে প্রায় ১ মিলিয়ন বা ১০ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
১৯১৮-১৯১৯ খ্রি: স্পেনিস ফ্লু: ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক: ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এই মহামারী দেখা দিয়েছিলো সেইসময় যখন পৃথিবী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় নিজেই চরম কাহিল । মার্চ ১৯১৮ তে আমেরিকার কানসাসে ট্রেনিংরত সৈন্যদের মধ্যে এর ব্যাপক প্রকোপ দেখা যায়। উৎপত্তি নিয়ে অনেক হাইপোথিসিস আছে, অনেকে মনে করেন চায়নায় উৎপত্তি হয়ে চায়নীজ শ্রমিকদের মাধ্যমে কানাডা হয়ে বা ইউরোপ হয়ে আমেরিকায় ছড়িয়ে পরে। পরে দ্রুততর এটি প্রতিটি মহাদেশেই কম বেশি ছড়িয়ে পরে। আনুমানিক ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয় । ১৮ মাস পর ১৯১৯ এর গ্রীষ্মকালে হঠাৎই ভাইরাসের প্রকোপ বন্ধ হয়ে যায়, ধারণা করা হয় ততদিনে এফেক্টেড মানুষজন হয় মরে গিয়েছিলো অথবা দেহ ভাইরাসটি প্রতিরোধ শিখে নিয়েছিলো। কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যেই ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ মরে গিয়েছিলো।এই মহামারীর পেছনে ছিলো H1N1 নামক আরেক ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। এই ভাইরাসের একটি ভয়াবহ দিক হলো এটি অল্প বয়স্কদেরও আক্রান্ত করেছিলো।
১৯৫৭-১৯৫৮ খ্রি: এশিয়ান ফ্লু :: ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ তে চায়না হতে উৎপত্তি হয়ে দ্রুত ইউেরাপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পরে।
সারা পৃথিবীেত প্রায় ১০ লক্ষ বা ১ মিলিয়ন মানুষ এই প্যানেডিমিকে মারা যায়। সবেচেয়ে বেশি মানুষ মাররা যায় আমেরিকায়।
১৯৬১-১৯৭৫ খ্রি: কলেরা প্যানডেমিক: এটি ছিলো সপ্তম কলেরা মহামারী। ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া ছড়িয়ে পরে। তারপর কলেরা ইটালী, নর্থ আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও ছড়িয়ে পরে।
আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়ে গেলেও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য সচেতনায় মৃত্যুহার একদম কমে যায়।
১৯৯১ তে দক্ষিন আমেরিকার পেরুতে ঐ সপ্তম কলেরা মহামারীর একই ব্যাকটেরিয়ার প্রাদুর্ভাবে হঠাৎ করে ১০০০০ মানুষ মারা যায়।
বর্তমান সময়ে উন্নত বিশ্বে কলেরা প্রায় নেই বললেই চলে।
এইচ আই ভি: ১৯৮১ সালে প্রথম এই ভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হবার পর থেকে সারা বিশ্ব দেখেছ এর প্রভাবে ঘটিত এইডস রোগ কত ভয়াবহ। ১৯১৮ এর তথ্য মতে পৃথিবীতে ৩৭.৯ মিলয়ন এইডস রোগী রয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই পৃথিবী এইডসে মারা গেছে ৭ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ। আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশি প্রকোপ এইডসের।
২০০৯-২০১০ খ্রি: সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস:
মেক্সিকো হতে শুরু করে পরে অন্যান্য মহাদেশেও ছড়িয়ে পরে।
স্পেনিস ফ্লুর মতই এটিও একই ধরনের ভাইরাসের দ্বারা ঘটলেও এটি একটি new strain of H1N1 ভাইরাস। এ পর্যন্ত। ৬ কোটির উপর মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে লক্ষাধীক মানুষ।
ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, ইয়েলো ফিভার, ল্যপরোসি, হাম বা মিউজলেস,টাইফয়েড ইত্যাদি রোগও সময় সময় পৃথিবীর আনাচে কানাচে প্রাণঘাতি মহামারী হয়ে বারবার দেখা দিয়েছে, হয়তো প্যানডেমিক হয়নি, এপিডেমিকেই রয়ে গেছে ।
তবে আধুনিক উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এগুলো এখন আর মহামারী হয়ে ছড়ানোর পর্যায়ে নেই ।
আমাদের সাম্প্রতিক তিন দশক সময়ে ২০০৯ সোয়াইন ফ্লু সবচেয়ে বড় প্যানডেমিক হলেও আরও অনেকগুলো এপিডেমিক বা মহামারীর করাল থাবা পৃথিবীর মানুষকে সহ্য করতে হয়েছে... এর মধ্যে—-
ইবোলা ভাইরাস: ২০১৩-২০১৬ খ্রি: পুরো আফ্রিকা জুড়ে বিশেষ কের পশ্চিম আফ্রিকা ইবোলা ভাইরাস ঘটিত রোগের প্রকোপে পরে।
২০১৬ এর ৮ই মে তে প্রকাশিত WHO এর রিপোর্ট অনুযায়ী মোট আক্রান্ত ২৮, ৬৪৬ এবং মৃতের সংখ্যা ১১, ৩২৩।
জিকা ভাইরাস: ২০১৫ সালে ব্রাজিল হতে উৎপত্তি হয়ে এই ভাইরাসের আক্রমন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পরে। ২০১৬ এক নভেম্বরে থেমে যায়। আক্রান্তের সংখ্যা অনেক হলেও মৃতের সংখ্যা তুলনামূলক ছিলো অল্প।
সার্স: ২০০২-২০০৩ খ্রি:
Severe Acute Respiratory Syndrome (SARS) একটি ভাইরাস ঘটিক রোগ যা ঘটায় SARS coronavirus (SARS-CoV)। ২০০২ সালের নভেম্বরে সাউথ চীনে এই মহামারী ছড়িয়ে পরে এবং ৮,০৯৮ জন আক্রান্ত হয়, থামার আগে সারা পৃথিবীতে ১৭ দেশ মিলে ৭৭৪ জন মারা যায়।
মার্স: Middle East respiratory syndrome coronavirus (MERS-CoV) আরেকটি প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস, এর স্পেসিফিক কোন ভ্যাকসিন এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ কের সৌদি আরবে এর প্রকোপ দেখা যায়। মনে করা হয় উটের থেক্ এই ভাইরাস ছড়িয়েছিলে। সৌদিতে ২০১৪ পর্যন্ত ২৮২ জন মারা গেছে এই রোগে।
২০১৫ সালে দক্ষিন কোরিয়াতে আবার এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিলো।
বার্ড ফ্লু: এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা:
H5N1 ভাইরাসের কারণে ছড়ানো এই রোগ প্রথম ১৯৯৭ সালে চীনে মানুষের দেহে পাওয়া যায়।এর পর থেকে এতে আক্রান্ত ৬০% রোগীই মারা গেছে। আক্রান্ত হবার হার প্যানডেমিক হলে মৃতের সংখ্যা ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
এর আরও একটি ভয়াবহ রূপ আছে যা H7N9।
নিপাহ ভাইরাস:
১৯৯৮ খ্রিা: প্রথম মালেশিয়ায় ছড়ায়, ১৯৯৯ এর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ২৬৫ জন আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ১০৫ জন মারা যায়। এছাড়া সিংগাপুর , বাংলাদেশ ও ভারতে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে সময় সময়ে, ২০১৮ সালের হিসাবে এই পর্যন্ত ৭০০ আক্রান্ত হয়ছে যার অর্ধেকের বেশি আক্রান্ত রোগী মারা গেছে।
ডেঙ্গু ফিবার আউটব্রেক:
১৭৮০ সালে প্রথম এশিযা ও আমেরিকাতে এই রোগ পাওযা যায় যা এক প্রকার মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ছড়ানো জীবাণু মূলত চার ধরণরে dengue virus serotypes: DENV-1, DENV-2, DENV-3, and DENV-4। এর মধ্যে টাইপ -২ সবচেয়ে ভয়াবহ। ২০০৬ থেকে প্রতিবছর অনেক দেশে ডেঙ্গু মহামারী হিসাবে দেখো যায় ও প্রানহানী ঘটে। ঠিকমতো চিকিৎসা করা হলে মৃত্যু হার ১% , কিন্তু চিকিৎসা করা না হলে ২০% ও হতে পারে।
চলমান করোনাভাইরাস:
Severe acute respiratory syndrome coronavirus 2 (SARS-CoV-2) বা 2019 novel coronavirus (2019-nCoV) এর প্রকোপ শুরু হয় চায়নার উইহান শহর থেকে ২০১৯ খ্রি এর ডিসেম্বরের দিকে যা বিগত মাস দুয়েকে মোটামুটি পৃথিবীর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, রোজ রোজ মিডিয়াতে আমরা দেশে দেশে মৃত্যুর খবরও পাচ্ছি।
প্যানডেমিক হোক বা এপিডেমিক... আতংক এখন বিশ্বব্যাপী।আজ ৩রা মার্চ ২০২০ এর হিসেবে মোট আক্রান্ত ৯০৯৩৬ যার মধ্যে ৮০১৩১ চায়নায় ও মোট মৃতের সংখ্যা ৩১১৭ যার ৯০% চীনের হুবাই প্রদেশে।
পুরো বিশ্ব এখন এর ভেকসিনের অপেক্ষায় আছি। যত দ্রুত ভেকসিন চলে আসবে ততই মঙ্গল।
উন্নতির এক চরম পর্যায়ে আমাদের বসবাস বিধায় আমরা বিগত সময়ের প্যানডেমিক বা এপিডেমিক গুলোর ভয়াবহতম চিত্র ঠিক অনুধাবন করতে পারি না।
কিন্তু ইতিহাসে তাকালে সে ভয়াবহতায় ও মানুষের লাশের সংখ্যা গুনে মূর্ষে পরতে হয়।
আমার এই পাঠ ও এ লেখা সেই ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে বর্তমানে অধিক সর্তক হওয়ার উদ্দেশ্যেই।
( বি: দ্র: উল্লেখিত সব পরিসংখ্যান আনুমানিক এবং হালকা পাঠে যা সামনে পেয়েছি সেখান থেকে নেয়া, কোন একাডেমিক গবেষনা কর্মে ব্যবহারের ১০০ ভাগ উপযোগী নয়)
#প্যানডেমিক_ইতিহাস-০২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন